শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শবে-বরাতের করণীয় ও রমজান মাসের প্রস্তুতি

মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

যদি আমরা আরও এক বছর বেঁচে থাকি, অর্থাৎ আল্লাহপাক মেহেরবানী করে যদি আমদের হায়াত আরও এক বছর বাড়িয়ে দেন, তাহলে শবে বরাতের রাত আমাদের নছিবে আবার আসবে। মানুষের জীবনের শেষ প্রান্ত কবে হবে এটি কেউ বলতে পারে না। গত বছর এই রাতে আমাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন, এ বছর তারা আমাদের মধ্যে নেই। এই এক বছরে কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই-বোন, কেউ আত্মীয়-স্বজন। এরা আর কোনো দিনই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। তারা এমন এক স্থানে চলে গেছেন, যেখানে কোনো জীবিত মানুষ পৌঁছাতে পারে না, অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করারও কোনো উপায় নেই।
আমরা এখন বেঁচে আছি, কখন যে ডাক পড়ে যাবে কেউ বলতে পারি না। যে কোনো মুহূর্তে হজরত আজরাইল (আ.) মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ পাক অত্যন্ত মেহেরবানী করে আমাদের মৃত্যুর পূর্বেই এই মহান বরকতময় রাতটিকে এনে দিয়েছেন এবং আল্লাহপাকের লাখো শুকরিয়া যে, আমাদের এই রাতের বরকত ও ফজিলত হাছিল করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আমরা এই রাতটিকে নিজের জীবনের জন্য গণিমত মনে করে ইবাদত-বন্দেগী, তছবিহ-তাহলিল, নফল নামাজ, কুরআন পাক তেলাওয়াত এবং ওয়াজ-নছিহত শোনার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ। এই রাত সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এক রাতে তাহাজ্জুদ নামাজে রাসূলে পাক (সা.) এত দীর্ঘ সময় সেজদারত থাকলেন, আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম যে, রাসূলে পাক (সা.) বুঝি এই দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। আমি বিচলিত হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে নাড়া দিলাম, তাতে তিনি নড়ে উঠলেন। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে নিজ স্থানে চলে এলাম। নামাজ শেষ করে কিছু বলার পর তিনি ইরশাদ করলেন, হে আয়েশা! আজ কোন রাত জান? আমি বললাম, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলই অধিক জানেন।
তিনি বললেন, আজ শাবান মাসের ১৫তম রাত। এই রাতে আল্লাহপাক দুনিয়াবাসীকে কৃপা করেন। এ রাতে বিশ^বাসীর তকদির সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিষয়ের নথিপত্র কার্যকর করার জন্য ফেরেস্তাদের কাছে হস্তান্তর করেন, যার মধ্যে জন্ম, মৃত্যু, রিজিক, দৌলত, জয়-পরাজয়, মানসম্মান, সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন ইত্যাদি সন্নিবেশিত থাকে।
এ রাত সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হা মিম’ সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি এই কিতাব (কোরআন মজিদ) নাজিল করেছি এক বরকতময় রজনীতে, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। (সূরা দুখান, আয়াত: ১-৪)
উপর্যুক্ত আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহপাক তাঁর কুরআনকে এই রাতে নাজিল করেছেন, আবার সূরা কদরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহপাক তাঁর কোরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছেন। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এর মধ্যে কোনটি সঠিক? আসলে দুটোই সঠিক। এর অর্থ হলো আল্লাহপাক কোরআন শবে-বরাতে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল করেছেন এবং এখান থেকে অল্প অল্প করে অর্থাৎ প্রয়োজনানুসারে হজরত জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে রাসূলেপাক (সা.) এর কাছে নাজিল করেছেন শবে-কদরে। এরপর এটিকে কার্যকর করেছেন রাসূলেপাক (সা.)। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আর কার্যকর করা এক জিনিস নয়। কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, কিন্তু কার্যকর হয় কোনটা সাথে সাথে, আবার কোনটা কার্যকর হয় দেরিতে। যেমন, সংসদে আইন পাস হয় যে, সন্ত্রাস করলে এর জন্য সাজা হবে এত দিন, জরিমানা হবে এত টাকা। এই আইনটা কার্যকর হবে তখনই, যখন কোনো লোক সন্ত্রাসী কাজে ধরা পড়বে এবং প্রমাণ হবে, সে সন্ত্রাস করেছে, এর আগে নয়।
রাসূলে পাক (সা.) এর কাছে অল্প অল্প করে নাজিল করার যৌক্তিকতাও এটিই। যখন কোনো সমস্য সৃষ্টি হয়েছে, কোনো নতুন বিধান আরোপের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তখনই আল্লাহপাক হযরত জিব্রাইল (আ.) কে পাঠিয়ে আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দিয়েছেন। তবে সিদ্ধান্তটি কিন্তু আল্লাহপাক অনেক আগেই গ্রহণ করেছিলেন। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাতটি হলো আজকের এই শবে-বরাত। আল্লাহ পাক সূরা দুখানের ৪নং আয়াতে বলেছেন, এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় অর্থাৎ আল্লাহপাক এই রাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সর্বনিম্ন আকাশে পাঠিয়ে দেন।
সুতরাং আজকের রাতটি হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাত। এ রাতেই আগামী এক বছরের বাজেট পাস হয়ে যাবে। কাজেই এই বাজেট পাস হওয়ার আগেই যার যার মনের কামনা-বাসনা আল্লাহপাকের দরবারে পেশ করতে হবে। কারণ, আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের সে সুযোগ দিয়েছেন। তিনি আজ সর্ব নিম্ন আকাশে বান্দাদের আরজী শোনার জন্য অবস্থান করছেন এবং মেহেরবানী করে বান্দাদের আরজী মঞ্জুর করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছেন। তাই প্রতিটি বান্দার কাজ হলো আল্লাহর কাছে চাওয়া, বেশি বেশি করে চাওয়া। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ জিনিস যদি কোন বান্দা আল্লাহর কাছে চায়, তা হলেও আল্লাহপাক খুশি হন। বারবার তওবা ভঙ্গ করেও যদি আল্লাহ পাকের দরবারে আকুতি-মিনতি করে চাওয়া হয়, তাহলেও আল্লাহপাক কাউকে ফিরিয়ে দেন না।
এ মাসে রাসূলেপাক (সা.) কখনও বেশি বেশি রোজা রাখতেন আবার রোজা একেবারেই ছেড়ে দিতেন। যেমন, হজরত মা আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলেপাক (সা.) এমনভাবে রোজা রাখা শুরু করতেন, আমার মনে হতো তিনি আর রোজা ত্যাগ করবেন না। রমজান ছাড়া কোনো মাসেই এত অধিক রোজা রাখতে আমি তাঁকে দেখিনি। অন্য এক হাদিসে হজরত মা আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলে পাক (সা.) রোজা রাখতে শুরু করতেন, মনে হতো তিনি আর ইফতার করবেনই না। আবার যখন রোজা রাখা বন্ধ করে দিতেন, তখন মনে হতো যে তিনি আর রোজ রাখবেনই না। শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে রাসূলে পাক (সা.) বলেন, এ বছর যারা মারা যাবে, তাদের নাম এই মাসেই লিখে নেয়া হয়। এজন্য আমি পছন্দ করি যে, আমার নামটা যখন তালিকাভুক্ত করা হবে, তখন যেন আমি রোজাদার থাকি। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলে পাক (সা.) এর কাছে জানতে চাওয়া হলো যে, কোন রোজা উত্তম? তিনি উত্তরে বললেন যে, শাবানের রোজা। কারণ এই রোজা রমজানের রোজার সম্মানের জন্য। অন্য এক হাদিসে আছে, হজরত মা আয়েশা (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি শাবান মাসের শেষ সোমবার রোজা রাখবে আল্লাহ পাক তার গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
মোট কথা, এ মাস থেকেই প্রতিটি মুমিন মুসলমানকে প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজেকে পাপমুক্ত করতে হবে, যাতে করে পরবর্তী মাস অর্থাৎ রমজান মাসের পূর্ণ আদব রক্ষা করা যায়। কারণ, ঐ মাসের রোজা হলো ফরজ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর ফরজ করা হয়েছিল।’ এই রোজা না রাখার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো লোক রোগাক্রান্ত হয় অথবা মুসাফির হয়, আর কেউ যদি এমন বার্ধক্যে পৌঁছে যায় যিনি রোজা রাখতে অক্ষম, তাকে আল্লাহপাক অনুমতি প্রদান করেছেন রোজা না রাখার। যা হোক, মনে রাখতে হবে, শাবান মাসটি রমজানের পূর্ববর্তী মাস। এই মাসের প্রস্তুতির ওপরই নির্ভর করে রমজানের সাফল্য। কাজেই রমজান মাসটা যেন ভালভাবে কাটাতে পারি তার জন্য আল্লাহপাকের মদদ প্রয়োজন। তাই আল্লাহপাকের সাহায্যের জন্য বেশি বেশি করে কাঁদুন। চোখের পানি ফেলুন। কারণ, আল্লাহপাকের কাছে বান্দার চোখের পানির অত্যাধিক মর্যাদা। রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুর চেয়ে উত্তম হলো আল্লাহ পাকের কাছে বান্দার চোখের পানি। নফল নামাজ পড়তে থাকুন। তবে মনে রাখবেন, বাজারে যে বই পাওয়া যায়, তাতে লেখা আছে, এই সূরা পড়তে হবে, ঐ সূরা পড়তে হবে এবং এতবার পড়তে হবে, এই দোয়া করতে হবে। আসলে এর কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার যে সূরা মনে আসে, সেই সূরা দিয়েই নামাজ পড়বেন। সওয়াব আল্লাহপাক আপনাকে দেবেন আপনার মনের অবস্থা দেখে, খুলুছিয়ত দেখে। দোয়ার বেলায় আপনার যা মনে আসে, নিজের জন্য, ছেলেমেয়ের জন্য, মা-বাবার জন্য, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার জন্য দোয়া করবেন। কৃষি, চাকরি, ব্যবসার উন্নতির জন্যও দোয়া করবেন। সচ্ছলতার জন্য, হালাল রুজির জন্য, রোগমুক্তির জন্য। অর্থাৎ কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তওবা করবেন খালেছ নিয়তে।
এভাবে রাতটিকে কাটিয়ে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ পাক আপনার ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবেন।
আল্লাহ পাক আমাদের নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন। (সংকলিত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
রিফাত ২১ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৪৯ পিএম says : 0
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে একনিষ্ঠচিত্তে এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি করার এবং তার উসিলায় ক্ষমা, কল্যাণ ও বরকত লাভের তওফিক দান করুন। আমিন।
Total Reply(0)
মাহমুদ ২১ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৫২ পিএম says : 0
লাইলাতুল বরাত নিয়ে আসে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানের আগমন বার্তা। রমজান মাসকে সামনে রেখে শাবান মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের পালা শুরু হয়।
Total Reply(0)
সোহেল রানা ২১ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৫৪ পিএম says : 0
লেখাটি থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। দৈনিক ইনকিলাবকে ধন্যবাদ
Total Reply(0)
নাসির উদ্দিন ২১ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৫৭ পিএম says : 0
মহান আল্লাহর ক্ষমা, তার কাছ থেকে রিজিক, বিপদ থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য এ রজনী এক বিরাট সুযোগ এবং আল্লাহপাকই সে সুযোগ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর বান্দাদের জন্য। এ রাতে নিবিষ্টচিত্তে তার দরবারে তওবা করা, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা, নফল নামাজ আদায় করা, দরূদ-শরীফ পাঠ করা, দান-খয়রাত করা, তসবিহ-তাহলিল করা, দোয়া-মোনাজাত করা, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, কবর জেয়ারত করা এবং আল্লাহপাকের রেজামন্দি হাসিলের জন্য সারারাত ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকা বান্দার জন্য অপরিহার্য হিসেবে গণ্য।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন