বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আবেদন গতকাল মঙ্গলবার খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। এদিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৪ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ আদেশ খারিজ করেন। একই সঙ্গে আদালত বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরো কিছু গাইডলাইন দিয়ে দেয়া হবে। সুপ্রীম কোর্টের আদেশের পর আদালত থেকে বের হয়ে রীটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ হওয়ার ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল। রীটকারীর আইনজীবী ড. কামাল হোসেন আপিল শুনানিতে বলেছেন, হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়িত হলে এ ধরনের হেফাজতে মৃত্যু কমে যেতো। এর আগে ইউনিফর্ম ছাড়া (সাদাপোশাকে) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতারের ঘটনা গুরুতর বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির উল্লেখিত ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে ১৩ বছর আগে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শেষ শুনানিতে গত ১৭ মে আপিল বিভাগ এক পর্যায়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। এদিকে ওই শুনানিতে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ে যেসব নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে, তা দেশের সামাজিক বাস্তবতায় সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ না হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। শুনানির এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, পুলিশ যেভাবে অভিযোগপত্র তৈরি করে তার বেশিরভাগ গৎবাঁধা। এখানে তারা কোন ‘এপ্লিকেশন অব মাইন্ড’ প্রয়োগ করে না। পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষ এত ভুল করে, এটাই আদালতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এখন রাষ্ট্রপক্ষের অবেদনটি খারিজ হওয়ার ফলে বিষয়টির সুনিষ্পত্তি হলো।
আপীল বিভাগের রায়ের ফলে একটি বহুল বিতর্কিত ধারার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এই ধারাটি যে একটি স্বাধীন দেশের অনুপযোগী সেকথা ইতোপূর্বে প্রধান বিচারপতিও শুনানিতে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটি একটি কলোনিয়াল ধারা। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বস্তুত, সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা এবং বাক-ব্যক্তি তথা মতপ্রকাশের যে অধিকার দিয়েছে তার সাথে এই ধারা কার্যত সাংঘর্ষিক। দেশের চলমান বাস্তবতায় উচ্চতর আদালত যে রায় দিয়েছে তাকে ইতিবাচকতায় দেখা ছাড়া কোন উপায় নেই। ১৯৯৮ সালের যে মামলার সূত্র ধরে হাইকোর্ট রায়টি দিয়েছিল সেখানে বলা হয়েছে, ডিটেনশন দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে স্বচ্ছ কাচ দিয়ে নির্মিত বিশেষকক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটআত্মীয় থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারী পরীক্ষা করাতে হবে। ১৯৮৮ সালে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের পর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবেলের পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু হয়েছিল। এরপর লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট- ব্লাস্ট একটি রীট করেছিল। এই প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই দুই ধারা সংশোধনের রায় দেন। দীর্ঘ ১৩ বছর পর এই আপিলের শুনানী হয়। দেশে অপরাধ আছে থাকবে। অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত সকলেরই কাম্য। নিঃসন্দেহে সারা দুনিয়াতেই অপরাধের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। তার অর্থ এই নয় যে, অপরাধ তদন্তের নামে যখন তখন যে কাউকে গ্রেফতার করা সমীচীন। অন্যদিকে ডিটেনশনের নামে অসুস্থ হয়ে পড়া বা মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটবে। সাদাপোশাকে গ্রেফতারের ফলে কে কাকে কেন কোন উদ্দেশে গ্রেফতার করছে তা জানা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। এ যাবৎকালের প্রকাশিত রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রেফতারের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্বীকার না করলে এর আর কোন ভিত্তি থাকে না। এটি নাগরিক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত। এই ধরনের গ্রেফতার নিয়ে দেশের মানবাধিকারর সংস্থাগুলো বারবার তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং অবস্থান তুলে ধরছে। পুলিশ প্রধানও এর আগে সাদাপোশাকে গ্রেফতারের বিরোধিতা করেছেন। এবারে আবেদনের শুনানীকালে এটর্নী জেনারেল কার্যত মানবাধিকারের বিপক্ষেই ওকালতি করেছেন। রায়ের ফলে গ্রেফতার বাণিজ্যেরও কার্যকর অবসান হতে বাধ্য। প্রায়শঃই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে যাদের নিয়ে যাওয়া হয় তাদের অনেকেরই খোঁজ পাওয়া যায় না। আবার অনেকের লাশ পাওয়া যায় এখানে সেখানে। আবার টাকা-পয়সা দিলে অনেকেরই সন্ধান মেলে। মাঝে-মধ্যেই খবর আসে টাকা-পয়সা চেয়ে না পেলে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। পরিস্থিতি কতটা গুরুতর আকার ধারণ করেছে তার বিবরণ শুনানীকালে প্রধানবিচারপতিও দিয়েছেন। কার্যত, দেশে গুম, হত্যা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের মতো ঘটনা যখন একের পর এক ঘটেই চলেছে আর জনগণ এসব ঘটনার জন্য প্রকৃত বিবেচনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্যকে যখন দায়ী করছে, তখন এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের রায় প্রকৃতপক্ষে জনআকাক্সক্ষারই প্রতিনিধিত্ব করছে।
রাষ্ট্রপক্ষের অবেদন খারিজ করে দেয়া মূলত এক ঐতিহাসিক রায়। আমরা এই রায়কে অভিনন্দন জানাই। দেশের সর্বস্তরের জনগণও অভিনন্দন জানাবে। এই ঐতিহাসিক রায়ের ফলে আদালতের উপর জনগণের আস্থা অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা মনে করি। একটি রাষ্ট্র জনবান্ধব না জুলুমবান্ধব হবে সে বিবেচনাকেই আপিল বিভাগের বিচারকগণ কার্যত প্রাধান্য দিয়ে গণমুখী হবার পক্ষে রায় দিয়েছেন। ইতোপূর্বেকার রায়েও হাইকোর্ট সেটাই করেছিল। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ রায় মেনে চলার মাধ্যমে জনগণের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন, যা খুবই ইতিবাচক একটি সূচনা বলে বিবেচিত হতে পারে। রাষ্ট্র নাগরিকদের কল্যাণের জন্য। সেই রাষ্ট্রে যখন তখন যে কাউকে যে কেউ গ্রেফতার করবে বা ডিটেনশন দিবে এটা কোন বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নাগরিকদের প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই রায়ের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। আমরা আশাকরি, দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের বিবেচনা থেকেই সংশ্লিষ্ট সকলে রায়টি মান্য করে চলবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন