শ্রীলংকায় গত রোববার ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা প্রধানত গির্জা ও হোটেলকে তাদের লক্ষ্যস্থল করেছে। রাজধানী কলম্বো ও শহরতলীর তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে হামলা চালানো হয়েছে। এছাড়া আরও দুটি স্থানে হামলা হয়েছে। এই আট স্থানে হামলায় সর্বশেষ খবর মোতাবেক ২৯০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬ জন বিদেশী। হামলায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। স্টার সান ডে উপলক্ষে গির্জাগুলোতে যখন খৃস্টান ধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনারত ছিলেন, হামলা তখনই হয়। অন্যদিকে যেসব হোটেলে সাধারণত পর্যটকরা অবস্থান করেন, সেই সব হোটেলই আক্রান্ত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা বাড়ার এটা একটা বড় কারণ। হামলার ধরন থেকে বুঝা যায়, একটি একক গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেনি। সরকারের তরফ থেকেও কোনো গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, সরকার হামলাকারী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। পুলিশ প্রধান এজন্য অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীকেই দায়ী করেছেন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত ১১ এপ্রিল পুলিশ প্রধান দেশের সর্বত্র ‘একটি গোয়েন্দা সতর্কবাণী’ পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য গির্জাগুলোয় আত্মঘাতী হামলা হতে পারে বলে আশংকা করেছিলেন। পুলিশ প্রধান যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন তাতে ‘একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার’ বরাত দেয়া হয়েছিল। সর্তকবাণীতে ‘ন্যাশনাল তৌহিদী জামাত’ (এনটিজে) নামে মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি স্থানীয় সংগঠন এই হামলার পরিকল্পনা করছে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তুু সংগঠনটির এরূপ ব্যাপক হামলা চালানোর শক্তি-সামর্থ আছে বলে তাতে কোনো ইঙ্গিত ছিল না। হামলার পর সংগঠনটি নিন্দা জানিয়েছে এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে। শ্রীলংকার সরকার এ সম্পর্কে কিছু না বললেও ভারতীয় গণমাধ্যমে এই হামলার জন্য এনটিজেকে দায়ী করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রামাসিংহে বলেছেন, সরকারের কাছে এ ধরনের হামলার তথ্য ছিল, তবে সরকার এ ব্যাপারে নিবারক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
শুধু শ্রীলংকাতেই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় গত এক দশকের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। কেবল হতাহতের দিক থেকেই নয়, ব্যাপকতার দিক দিয়েও। যারাই এ হামলা চালাক না কেন, তারা মানবতার বিরুদ্ধে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ হামলা মানবতা ও সভ্যতার বিরুদ্ধে হামলা, ধর্মের বিরুদ্ধে হামলা। মানবতা, সভ্যতা এবং কোনো ধর্মেই নিরিহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যা সমর্থিত নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ক্রমশই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এবং হত্যা-সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যম তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে। গত ১১ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে উগ্রবাদী সন্ত্রাসীর হামলায় ৫০ জন নিহত ও বহু আহতের পর শ্রীলংকায় ঘটলো এই লোমহর্ষক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। সেখানে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, এখানে বিশেষভাবে খৃস্টানদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ধর্মীয় বিভেদ এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা ছড়িয়ে দেয়া এসব হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। শ্রীলংকার ঘটনায় সেখানকার ধর্মীয় সহনশীলতা, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বিনষ্ট এবং অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্য স্পষ্ট। পর্যটন শ্রীলঙ্কার জাতীয় আয়ের একটি প্রধান উৎস। হোটেলগুলো হামলার শিকার হওয়ায় সেখানে ভবিষত পর্যটকদের প্রবাহ কমে যেতে পারে, যা শ্রীলংকার অর্থনীতিক বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য। অত্যন্ত দু:খজনক, সন্ত্রাসী এই হামলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মেয়ের ঘরের এক নাতি নিহত হয়েছে। জামাইও আহত হয়েছে। এছাড়া দু’জন বাংলাদেশীর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেলগুলোতে যারা হতাহত হয়েছে, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই পর্যটক।
এতগুলো মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা শ্রীলংকাকেই শোকে স্তব্ধ করে দেয়নি, দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা বিশ্বেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, আর কতদিন নিরিহ-নিরপরাধ মানুষ এভাবে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হবে? ধর্মের নামে, বর্ণের নামে এভাবে মানুষ হত্যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কোনো ধর্মই আকারণ মানুষ হত্যা সমর্থন করেনা। কাজেই, ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাসের কালো ঘোড়া চালিয়ে দেয়, নিদোর্ষ মানুষ হত্যা করে, আহত করে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসীই, তাদের কোনো ধর্ম নেই। এই ‘ধর্মহীন কুলাংগারদের’ ধরতে হবে এবং ফাঁসিকাষ্টে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এখনো জানিনা, কারা এই ঘৃণ্য অপকর্ম করেছে। শ্রীলংকার সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সর্তকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে আগাম কোনো গোষ্ঠীর ওপর অঙ্গুলি উত্তোলন করা হয়নি। আমরা দেখেছি, এধরনের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে বেøম গেম চলে। আর এই বেøম গেমের কারণে প্রকৃত দোষীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। শ্রীলংকার সরকারকে আরও সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে। ঘটনার নিরপেক্ষ ও অনুপুংখ তদন্ত করতে হবে। দোষীদের শনাক্ত করে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে হবে। এই বিপুল প্রাণহানিকর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা শ্রীলংকার সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এই ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছে তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সহমর্মিতা। কোথাও, কোনো দেশে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক, এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন