অটিজম শব্দটি আজকাল অপরিচিত কোনো শব্দ নয়, বরং চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা এবং সরকারের প্রচারণা ও সহযোগিতায় অটিজম শব্দটি বেশ গ্রহণযোগ্য পরিচিতি পেয়েছে। আজকাল ব্যাপক প্রচারের ফলে অটিজম নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হয়েছে। যেমন যেসব শিশু শুধু কথা বলছে না অন্যান্য ব্যবহারগত দিক ঠিক আছে, তারা শিশুটিকে অটিস্টিক ভেবে ভুল করছেন, আবার অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিশুকেও বলা হচ্ছে অটিস্টিক। অটিজম শব্দটির যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৪৩ সালে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা: লিও কের্নার অটিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। কাছাকাছি সময়ে জার্মানির ডা: হ্যান্স এসপার্গার একই ধরনের অসুখকে এসপার্হার সিন্ড্রোম হিসেবে নামকরণ করেন। ২০০৮ সালে জাতিসঙ্ঘ ২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিবেসে ঘোষণা করে, যা অটিজম চিকিৎসা ও সচেতনতাকে বহু গুণ বাড়িয়েছে। অটিজম কথার অর্থ হলো নিজেকে গুটানো। সমাজ থেকে, পরিবার থেকে ও পরিবেশ থেকে নিজেকে গুটিয়ে আড়াল করে একাকিত্ব জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া। কেনার শব্দটি প্রথম আলোচনা করেন।
এটি এক ধরনের ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, যেখানে জন্মগত ভাবেই কিছু সমস্যা ও আচরন হয়, ফলে একজন স্বাভাবিক শিশু যেমন কথাবার্তা, যোগাযোগ ও আচারব্যবহার করে, অটিস্টিক শিশুরা তা করতে পারে না। প্রায় ৫.২/১০০০ অর্থাৎ হাজারে ৫.২টি শিশু এই অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। ছেলেমেয়ে সবাই আক্রান্ত হতে পারে। তবে ছেলেরা প্রায় চারগুণ বেশি ভুক্তভোগী।
অটিজমের কারণ কী : অটিজমের কারণ নির্দিষ্ট কোনো কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তবে জেনেটিক, জন্মগত, বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাবের সংমিশ্রণ কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। * জন্মগত (৫০%) * সন্তান প্রসবকালীন সময়, স্থান ও পদ্ধতি খুবই স্পর্শকাতর ইস্যু। কোনো কারণে মাথায় আঘাত পাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া ও অন্য কোনো বড় অসুখ ইত্যাদি। * বায়োলজিক্যাল কারণের মধ্যে পংভম হোমোভিনিলিক এসিড বেশি থাকে।* ক্রোমোজোম সমস্যা থাকে। * সাইকোলজিক্যাল কারণের মধ্যে পিতামাতা খুব ‘ইমোশনালি ডিটাচড’ থাকা। লক্ষণ-প্রধান লক্ষণের মধ্যে * শিশুর সামাজিক বিকাশ একদমই হয় না। যেমন বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, সমবয়সীদের সাথে কোনোভাবেই সম্পর্ক করতে পারে না। * কোনো কোনো শিশু একদম কথা বলে না, আবার কেউ কেউ কথা পুরো বাক্য বুঝিয়ে বলতে পারে না আবার অনেকের কথা ঠিকমতো শুরু হয়, কিন্তু তিন বছরের পর হঠাৎ কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। আচারব্যবহারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে, যেমন-একই কাজ বার বার করে। *চোখের দিকে থাকায় না। নিজের মতো চলাফেরা, কাজকর্ম করে। এছাড়া-*বাবা-মায়ের আদার-সোহাগ বোঝে না, একটি শিশুকে কোলে নিলে যেমন হাসে, তাকায়, এ ধরনের শিশুরা এগুলো বোঝে না, তাকে তার মা নিয়েছে না অন্য কেউ নিয়েছে, কোনো তফাত থাকে না। * সমবয়সীদের সাথে মিলে না, কোনো খেলাধুলা শেয়ার করে না, একাকিত্ব জীবন যাপন করে। * একই ধরনের খেলনা, একই ধরনের খেলা ও খাবার বেশি পছন্দ। * একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে হাত তালি দেয়া, শব্দ করে, টেবিলের চতুর্দিকে হাঁটা, দৌড়াদৌড়ি করে। * কোনো কোনো সময় নিজের কথা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না দেখে শরীরে আঘাত করে।
অটিজম প্রতিরোধ- * গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো মতেই ওষুধ না খাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, মৃগীরোগের ওষুধে অটিজম বেশি হতে পারে। * মায়ের মদপানের অভ্যাস থাকলে সন্তান নেয়ার আগে তা ছেড়ে দেয়া। * বেশি বয়সে সন্তান না নেয়া এ ক্ষেত্রে পিতার বয়সকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। * সন্তান নেয়ার আগে মাকে রুবেলা ভ্যাকসিন দেয়া।* সন্তানকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ানো। গবেষণায় দেখা গেছে, বুকের দুধ না খাওয়ালে শিশুর অটিজমের ঝুঁকি বেশি থাকে। * সাধারণত প্রতি এক শ’তে ০.৫ জন আর প্রথম শিশু অটিজম হলে দ্বিতীয় শিশুর অটিজম হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় ৮ শতাংশ। আর যমজ শিশুর মধ্যে বৃদ্ধি পায় ৭৫ শতাংশ। * সন্তান জন্মের সময় যদি সন্তানের ওজন কম থাকে এবং ৩৫ সপ্তাহের আগে সন্তান প্রসব হয়, এমন শিশুর মধ্যে ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মায়ের ওজন বৃদ্ধিও স্বাস্থ্য পরিচর্যা একান্ত প্রয়োজন। *ফিনাইল কেটোনোরিয়া ও সিলিয়াক রোগ দ্রæত নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা করা দরকার। * বাবা-মায়ের সিজোফ্রেনিয়া মুড ডিসঅর্ডার থাকলে সন্তানের মধ্যে অটিজম বেড়ে যেতে পারে। * পরিবেশ থেকে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে ঝুঁকি কম থাকে। বর্তমানে সারা বিশ্বে অটিজম নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। প্রতিটি শিশুর মাঝেই আছে বিপুল সম্ভাবনা। তাই অটিস্টিক শিশুকে বোঝা মনে না করে বা লুকিয়ে না রেখে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা উচিত।
চিকিৎসক-কলামিস্ট
মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন