শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অবহেলিত নজরুল

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গতকাল ২৫ ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে দেশের গণমাধ্যম ও  দৈনিক পত্রিকাগুলো নজরুলকে স্মরণ করে এবং গতানুগতিক ধারায় তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। গতকাল একটি ইংরেজী পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা গেল, বাংলা একাডেমীর বটতলায় স্থাপিত নজরুলের আবক্ষ ভাস্কর্যটির ব্রোঞ্জের রং পাখ-পাখালী’র বিষ্ঠায় বিবর্ণ হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাঠ্য কারিকুলামে নজরুল যে চরমভাবে অবহেলিত হচ্ছে, তার বিবরণ নতুন করে উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে নজরুল এক অবিসম্বাদিত বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর সাহিত্যের পরতে পরতে একটি বৈষম্যহীন, ঔপনিবেশিক শোষণমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নের বীজ বপিত হয়েছিল। এ কারণেই নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। এই বোধকে লালন করেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ১৯৭২ সালে অসুস্থ নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিল। কবির ইচ্ছানুসারে ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তৎকালীন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করে। স্বীকার করতে হবে, নজরুল প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন এবং তার চেতনার আলোকসম্ভার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জাতীয় দায়িত্ব পালনে সরকার এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তনের ধারা নির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় কবি নজরুলের কবিতা-সাহিত্যকর্ম অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে। নজরুলের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং জাতীয় পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে তা জাতীয় চেতনায় স্ফুরিত করার দায়িত্ব পালনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা বা অনীহা একটি প্রমাণিত সত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের শুরু থেকেই নজরুলের সাহিত্যকর্মের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বাঙ্গালী মুসলমানের স্বপ্নপূরণ ও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত হলেও এখানে নজরুলের অবমূল্যায়ন জাতীয় চেতনার পরিগঠনে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। নিজ দেশে কোন জাতীয় কবির এমন অমর্যাদা ও অবমূল্যায়নের ঘটনা সারাবিশ্বে বিরল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের কলম ছিল আপসহীন। এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির সপক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী উচ্চারণ প্রথম নজরুলের কবিতায়ই উঠে এসেছিল। আমার কৈফিয়ত কবিতার শেষ দুই লাইনে নজরুল লিখেছেন, ‘প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।’ এভাবেই গণমানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নজরুলের কবিতা প্রেরণার অগ্নিমশাল হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার কারণে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। কারাগারে নজরুলের অনশন ভাঙাতে কবি রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠির জবাবে, নজরুল লিখেছিলেন,‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই শামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুও ঘটে তাহলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে’। সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে আমরা যখন এক চরম অবক্ষয় ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছি, তখন নজরুলের সাহিত্য আমাদেরকে পরিত্রাণের অনন্য প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
বাংলা সাহিত্যাকাশে নজরুল এক বিস্ময়কর প্রতিভা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বরাবরই অবহেলা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যক্রম বোর্ডের স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচি থেকেও নজরুলের সাহিত্যকর্ম হ্রাস করার তৎপরতা দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পাস করতে হলে ১৮০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সেখানে ১৯২১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নজরুল বিষয়ক পাঠ্য ছিল মাত্র ১৬.৪ নম্বরের। অর্থাৎ নজরুল সম্পর্কে কিছু না পড়ে বা না লিখেও একজন ছাত্র বাংলা সাহিত্যে অনার্স পাস করতে পারে। সম্প্রতি এখানে ১০০ নম্বরের নজরুল পাঠ্য কোর্স যোগ করা হয়েছে বলে জানা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র একটি নজরুল গবেষণাকেন্দ্র থাকলেও এই কেন্দ্রের গবেষণা ফলাফল একেবারেই নগণ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮টি গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে সাহিত্য-সামাজিক গবেষণা সম্পর্কিত ১৫টি কেন্দ্রের মধ্যে নজরুল গবেষণাকেন্দ্র একটি। এই কেন্দ্রের বাজেট বরাদ্দও অন্য যে কোনটির চেয়ে কম। ২০১০ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, আগের বছর নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ৭৫ হাজার টাকা বাজেট বরাদ্দ দিলেও গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ টাকা। এ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নজরুলের গুরুত্ব কতটা তা’ বোঝা যায়। পাকিস্তানের শাসকরা এক সময় রবীন্দ্র সাহিত্যের উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। এ দেশের মানুষ তা’ সহজভাবে মেনে নেয়নি। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নজরুলকে নানাভাবে অবহেলা করা হলেও এদেশের গণমাধ্যম, তথাকথিত সুশীল সমাজসহ জাতীয়ভাবে রবীন্দ্র বন্দনার আতিশয্য বেড়েই চলেছে। সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতাও বেড়ে চলেছে। আজকের জাতীয় জীবনে অবক্ষয় ও লুণ্ঠনের রাজত্ব থেকে মুক্তি পেতে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবতাবাদী চেতনায় নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। জাতীয় পাঠ্যক্রমে নজরুলের জীবন ও সাহিত্য আরো অনেক বেশী কলেবরে বাড়াতে হবে। অনুবাদ ও গবেষণার মাধ্যমে নজরুল সাহিত্য সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া এখন সময়ের দাবী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন