শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার নির্দেশনার বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের খারিজ করে দেয়াকে ঐতিহাসিক রায় বলে উল্লেখ করেছেন দেশের শীর্ষ আইনবিদরা। তারা মনে করেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ এক যুগান্তকারী রায়। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের মানবাধিকার সংগঠনসমূহ এবং বিশিষ্টজনরাও মনে করেন, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় জনস্বার্থে বাস্তবায়ন করা জরুরী। দীর্ঘদিন ধরে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতনসহ আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছিল। তারা মনে করেন, আইনের অপপ্রয়োগ রোধে এ রায় কার্যকর ভূমি পালন করবে। আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে। হাইকোর্টে রীট দায়েরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেন আলোচ্য রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, মনে হচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করেছি। এটর্নী জেনারেল বলেছেন, পৃথিবীর কোথাও সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা হয় না। সাদা পোশাকে গ্রেফতার করা নিয়ে আমাদের দেশে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। শত্রুতাবশত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে গায়েব করার ঘটনাও রয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, আপিল বিভাগের এই রায়ে এটা বন্ধ হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মান্য করতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেছেন, কেউ যদি নির্দেশনা অমান্য করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনের মধ্যে কিছু জরুরী ধারা-বিধান থাকে, ৫৪ ধারাও একটি জরুরী বিধান। জনগণের উপকারার্থে দরকার হলে আমরা অবার এটি সংশোধন করব।
৫৪ ধারা এবং রিমান্ডে নেয়ার ধারা নিয়ে কেবলমাত্র যে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে ব্যাপারটি এমন নয় বরং এনিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও বড়ধরনের আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ৫৪ ধারা ও রিমান্ডের নির্যাতন নিয়ে বরাবরই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। গত বছর মার্চে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে গুম, খুন, গ্রেফতার আতঙ্কে ৩০ লাখ মানুষের ফেরারি জীবন চলছে। বিরোধী মত তথা প্রতিপক্ষকে দমনে এযাবৎকাল ৫৪ ধারাই ব্যবহার করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে যে গণগ্রেফতার হয়েছে তা মূলত ৫৪ ধারা ব্যবহার করেই করা হয়েছে। ৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময়ও এই ধারাটি বাতিলের ব্যাপারে জনমত গঠিত হয়েছিল। জনতার চাপের মুখে পদত্যাগের সময় এরশাদ সরকার এটি বাতিলও করেছিল। তবে কিছু জটিলতার কারণে তা তখন গৃহীত হয়নি। পরবর্তীতে সে সময়ের সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির সম্মতি না থাকায় কার্যত এই ধারা বহাল থেকে যায়। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়েও এই আইনের অপব্যবহার হয়। প্রতিপক্ষ দমনে এ ধারার ব্যাপক অপব্যবহারের ফলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ১৯৯৮ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শামিম আহসান রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের পর ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ডিবি হেফাজতে রুবেলের হত্যাকা- জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে। রুবেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আলোচ্য ধারাগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চতর আদালতে রীট করা হলে আদালত ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ ও সাদা পোশাকে গ্রেফতার সংক্রান্ত বিষয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করেন এবং তার সাথে কয়েক দফা সুপারিশ করে রায় দেন। বাস্তবত সেগুলো কার্যকর না হবার কারণেই ৫৪ ধারার অপব্যবহার হচ্ছে, নাগরিক অধিকার লংঘিত হয়ে আসছে। আপিল বিভাগের গত মঙ্গলবারের রায়ে জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। রীট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা আর সুপারিশ দেব না। আমরা গাইডলাইন দিয়ে দেব। এজন্য হাইকোর্টের রায়ে করা সুপারিশগুলো গাইডলাইনের মধ্যে থাকবে বলে আশা করছি। প্রকৃত বিবেচনায় ইতোপূর্বে হাইকোর্ট যেসব সুপারিশ করেছিলো সেগুলো অনুসরণ করা হলে আইনের অপব্যবহার রোধ করা যেত। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচ্য ধারাগুলোর অপব্যবহারের ফলে সারাদেশে এক ধরনের আতঙ্ক ও আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান রায়ের ফলে সাধারণ নাগরিকদের কিছুটা হলেও আইনের অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ধারা বহাল থাকার ফলে কে বৈধ কে নয়, তা নিশ্চিত হওয়া যেমন সম্ভব ছিল না। ফলে নাগরিকদের অসহায় শিকার হওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলনা। এখন তাদের মনোবল ও শক্তি অনেকখানি বৃদ্ধি পাবে। একটি স্বাধীন দেশোপযোগী মৌলিক ও মানবিক অধিকার রক্ষায় তারা সচেষ্ট হতে পারবে। আলোচ্য ধারাগুলো যে স্বাধীন দেশের অনুপযোগী ছিল, সেকথা শুনানীতে প্রধান বিচারপতিও বলেছিলেন। সুতরাং এখন আশা করা যায়, এ ধারায় যারা আটক হয়েছেন, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তারা ন্যায়বিচার পাবেন। যারা এই ধারায় গ্রেফতার হবার পর রিমান্ডে গিয়ে আর ফিরে আসে নাই তাদের স্বজনরাও হয়ত সুবিচার পাবেন। যারা গুম, হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের সুবিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এই ঐতিহাসিক রায়ের জন্য আমরা প্রধান বিচারপতি ও তার নেতৃত্বাধীন প্যানেলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। গণতন্ত্রে উত্তরণে এই রায় যে যুগান্তকারী ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিয়েছে তা যদি সব মহলের আন্তরিকতায় বাস্তবে রূপ নেয়, তবে এই রায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হবে। সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইনগুলো পাবার পর হয়ত চূড়ান্ত কথা বলা যাবে তবে আমরা মনে করি, আইন যতই ভাল হোক তা থেকে জনগণের সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি নির্ভর করে প্রয়োগের উপর। গত ১৩ বছর ধরে যা কার্যকর হয়নি তা রাতারাতি বা একদিনে কার্যকর হবে সেটা সুবিবেচনাপ্রসূত নাও হতে পারে। এজন্য অবশ্যই একটি স্বাধীন মনিটরিং সেল থাকতে পারে। নাগরিক অধিকার রক্ষায় সকলের সম্মতি থাকলে এবং সবাই একমত হয়ে সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করলেই সুপ্রিম কোর্ট যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে রায় দিয়েছেন, তার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সবার মনে রাখা দরকার, এ রায়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জনস্বার্থ সংরক্ষণ। আইনের অপব্যবহারে জনস্বার্থ বিশেষ করে নাগরিক অধিকার যাতে ক্ষুণœ না হয়, সেদিকে সতর্কতার সাথে নজর দিতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন