শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বড়ানো কবিরা গুনাহ

মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী | প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৯, ১২:১১ এএম

হালাল উপায়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা শ্রেষ্ঠ ইবাদত। পবিত্র হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, রাসুল (দ.) রজব মাস থেকেই মাহে রমজানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতেন। আর পুরো শাবান মাস নফল রোজা রেখে দেহ-মনকে প্রস্তুত করতেন প্রেমমাস রমজানের জন্য। সাহাবিরাও রমজান উপলক্ষে আত্মাকে সতেজ করতেন কোরআন তেলাওয়াত, নফল ইবাদত আর দান সদকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে। রাসুল (দ.) এবং আমাদের রমজান প্রস্তুতি সম্পূর্ণ উল্টো। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে প্রশিক্ষণের মাস রমজানে ভ্রাতৃঘাতী ও নির্মমতার চর্চাই বেশি হয় আমাদের দেশে। মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবসামগ্রী গুদামজাত করা হয় বেশি মুনাফার লোভে। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা রোজাদারদের গলায় ছুরি ধরে বেশি লাভের আশায় ৬ মাস ১ বছর আগে থেকেই প্রস্তুতি নিই। অথচ অনেক অমুসলিম দেশেও রোজার মাসে রোজাদারদের জন্য বিশেষ সেবা দেয়ার কথা শুনি থাকি। যেসব ব্যবসায়ী পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে তাদের ব্যাপারে রাসুল (দ.) কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা, বেশি মুনাফার লোভে দ্রবসামগ্রী গুদামজাত করা স্পষ্ট হারাম। মানুষকে কষ্ট দিয়ে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাতের ব্যাপারে অসংখ্য সহি হাদিস থেকে কিছু হাদিস এখানে উল্লেখ করা হল। হজরত মা’মার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (দ.) বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে সে বড় অপরাধী গন্য হবে। আর জেনে রাখ! সে গোনাহগার সাব্যস্ত হবে। (মুসলিম ও তিরমিজি।) প্রিয়নবী (দ.) আরও বলেনÑ ‘মুজরিম তথা অপরাধীর পক্ষেই সম্ভব পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা।’ (মুসলিম।) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসরা বলেন, আলোচ্য হাদিসে মজুতদারকে অপরাধী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘অপরাধী’ শব্দটি সহজ কোনো শব্দ নয়। মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে অপরাধী শব্দটি ফেরাউন, হামান ও কারুনের মতো প্রতাপশালী এবং অহংকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। যেমন পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল।’ (সূরা কাসাস : ৮)।
মজুতদারের নোংরা মানসিকতা ও কদর্যপূর্ণ স্বার্থপরতাকে মহানবী (দ.) এভাবে ব্যক্ত করেছেনÑ হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (দ.)কে বলতে শুনেছি, ‘গুদামজাতকারী কতই না ঘৃনিত মানুষ। আল্লাহ তায়ালা দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দিলে সে চিন্তায় পড়ে যায়। আর বাড়িয়ে দিলে সে আনন্দিত হয়। (শুআবুল ইমান ও মেশকাত।) হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (দ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, মানুষকে কষ্ট দিবে, সে এ সম্পদ দান করে দিলেও তার গোনাহ মােেফর জন্য যথেষ্ট হবে না। (মেশকাত।) খাদ্যদ্র গুদামজাতকারী সম্পর্কে রাসুল (দ.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিক প্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে সে অভিশপ্ত হবে। (ইবনে মাজাহ ও সুনানে দারেমি।)
আসন্ন মাহে রমজানে ব্যবসায়ী ভাইরা মজুতদারি থেকে নিজে বেঁচে থাকবেন। অন্যকেও এই ভয়াবহ গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। রোজাদারদের ঠকানোর গোনাহ থেকে আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করুন। হালালভাবে ব্যবসা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং দুনিয়ার সুখ, আখেরাতের মুক্তি লাভের পাশাপাশি নবী-সিদ্দিকদের সঙ্গে জান্নাতি হওয়ার তাওফিক আল্লাহ তায়ালা আমাদের দিন।

পবিত্র রমজান মাসে ব্যবসায়ী ভাইদের করণীয়: মুসলামনদের সবচেয়ে প্রিয় মাস পবিত্র মাহে রমজান । এ মাসটি মূলত ইবাদতের বসন্তকাল হিসেবেই সকল মুমিন মুসলমানদের কাছে পরিচিত। ইবাদাত, আত্মশুদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে এ মাসটি মুসলিম উম্মাহের জন্য ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে । অন্য সকল ইবাদাতের মর্যাদাকে ছাড়িয়ে পবিত্র হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘রোযা আমার জন্য এবং এর পুরস্কার আমি নিজেই দেব’। (বুখারি ও মুসলিম।)
রোযার মাস যেমনি ইবাদতের মাস, তেমনি এটি ভেজালমুক্ত খাদ্য গ্রহনের মাসও। দেশের সব মানুষের মানবতবোধ এক রকম নয়। মানবতার যেমন বন্ধুর অভাব নেই তেমনি শত্রুও কম নয়। রোজার মাস এলেই দেখা যায়, ইফতার সাহরী সমাগ্রীসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজীয় দ্রব্যের দাম হঠাৎ করে অনেক গুণ বেড়ে যায় । অথচ রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য মাসগুলোতে এ সকল খাদ্য দ্রব্যের দাম অনেকটাই সহনীয় পর্যায় কিংবা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকে। ব্যতিক্রম ঘটে শুধু পবিত্র রমজান মাসে। অধিক মুনফালোভীরা তাদের গুদামে পবিত্র রমজান মাসের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য দ্রব্য অবৈধ, অনৈতিকভাবে মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে রমাজানের একমাস কিংবা ১৫ দিন পূর্বে বাজারের চাহিদা অনুপাতে অনেক কম পরিমানে দ্রব্য বাজারে সরবরাহ করে এবং এর মূল্য বৃদ্ধি করে দেয়। যদিও এদের সংখ্যা কম কিন্তু বাজার ব্যবস্থাকে এই কম সংখ্যক ব্যাবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রন করছে । তাই রমজান শুরু হওয়ার আগে দেখা যায় চিনি, ছোলা বুট, পিয়াজ, সয়াবিন তেল, সকল প্রকার মসলা, ডালসহ এ জাতীয় পণ্যের মূল্য পূর্বের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা থেকে শুরু করে শতাধিক টাকা পর্যন্ত ও বেড়ে যায় ।
হযরত আবু সাঈদ খুদুরী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলেপাক (দ.) ইরশাদ করেছেন, সত্যবাদী আমানতার ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী ব্যক্তি হাশরের দিন নবী-সিদ্দিক ও শহীদদের কাতারে থাকবেন। (তিরমিজি।) ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, ভাবুন তো, আপনাদের সঠিক ব্যবসার মাধ্যমে কত বড় উচ্চ মর্যাদার সুযোগ রয়েছে!
পবিত্র রমজান মাস এলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ কি নির্বিঘেœ রোজা রাখবেন নাকি দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কথা ভেবে চিন্তায় দিনপার করবেন? এমনিতেই বাংলাদেশে বছরের পুরোটা সময় দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারনে মানুষের প্রচুর ক্ষোভের কথা শোনা যায়। এরপরেও যদি রমজান উপলক্ষে অমানবিকভাবে আরও কয়েকদফা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয় তবে সেটা শুধু অনৈতিক নয় বরং অমানবিকও বটে ।
ব্যবসার ব্যপারে ইসলাম কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছে। আল কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ব্যবসাকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে আর সুদকে করা হয়েছে হারাম।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ২৭৫।) ইসলামে ব্যবসায়ের সকল দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অথচ মুসলমানরা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অনৈতিকতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। নয়ত কোন মুসলমান ব্যবসায়ী ভাই রমজান মাসে দ্রব্য মূল্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে অন্য কোন মুসলানদের আল্লাহর স্মরণের পথে কি কখনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয় এবং মুসলমানগণ প্রতিযোগিতা করে রোজাদারদের সেবা দিয়ে থাকে।
অথচ আমাদের বাংলাদেশে কী হয় একবার ভেবে দেখুন! শুধু যে মুসলমানরা এ কাজ করে তা নয় বরং অন্য ধর্মাবলম্বী কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরাও অনৈতিকভাবে পণ্য দ্রব্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করে। যেখানে বিশ্বব্যাপী পবিত্র রমজান মাস আসলে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যায়; ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সেখানে আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থা রমজানের আগের সঙ্গে রমজানের সময়ের সাথে কোনো মিল থাকে না। এটি সত্যিই বড় বেদনার কথা।
সার্বিকভাবে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার লক্ষ্যে রোজাদারের যথাযথ দায়িত্ব পালন, আত্মশুদ্ধি অর্জন ও ইবাদত-বন্দেগিকে নির্বিঘœ করতে সব ব্যবসায়ীদের জন্যই এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। পবিত্র হাদিসের ভাষা অনুযায়ী আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর নিজ হাতের প্রতিদান লাভের আশায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে বরং কমিয়ে আনা এবং বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল না মেশানোই হবে সব ব্যবসায়ী ভাইদের নৈতিক দায়িত্ব।
ব্যবসায়ী বন্ধুরা যদি তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন তবে প্রত্যেক রোজাদার স্বস্তিতে ইফতার-সাহরীর সকল দ্রব্যমূল্য কিনতে পারবেন এবং তারা সঠিকভাবে রোজা পালন ও আত্মশুদ্ধি অর্জনে কষ্ট ও হয়রানির শিকার হবেন না। ব্যবসায়ীরা যদি তাদের ব্যবসায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, রোজাদারদের পাশে সহনুভূতির দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই তাদের জন্য থাকবে আল্লাহ তাআলার ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে দুনিয়ায় রহমত-বরকত এবং পরকালের মাগফিরাত ও নাজাতসহ অনেক অনেক কল্যাণ।
তাই আসুন, আমরা পবিত্র রমজান মাসকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে পালনের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও সহমর্মিতার সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে অঙ্গীকারবদ্ধ হই। রমজান মাসজুড়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে ভেজালমুক্ত খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন ও নৈতিক উন্নত চরিত্র গঠনে এগিয়ে আসি। মহান আল্লাহ তায়ালা সকল ব্যাবসায়ী ভাইকে রমজান মাসের পবিত্র রক্ষা এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনের তাওফিক দান করুন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন