পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতি বছর বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে এ মাসটি মুসলমানদের নিকট হাজির হয়। রমজান আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাস। এ মাসে মুসলমানগণ আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করে। এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পরবর্তী ১১ মাস যাতে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি সহকারে চলতে পারে সে চেষ্টাই করে থাকে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে অতি মুনাফা লাভের আশায় বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ে ঠিক সেভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। রমজানকে সামনে রেখে প্রতি বছর পণ্যের দাম বাড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। রমজান মাস শুরু হওয়ার পূর্বেই পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক। এবার যেন ভোক্তাগণ ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য ক্রয় করতে পারেন সেদিকে সরকারের দৃষ্টি রাখা খুবই প্রয়োজন। অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট যাতে সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সরকারি উদ্যোগে। বিশেষ করে এই মাসে যেসব পণ্যের চাহিদা খুব বেশি থাকে, সেগুলোর দামই সাধারণত রমজানকে সামনে রেখে বেড়ে থাকে। রমজান সহমর্মিতার মাস। একে অপরের প্রতি স¤প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমজানের মহান শিক্ষা। হাদিস শরীফে এসেছে, রোজাদারের সাথে গায়ে পড়ে যদি কেউ ঝগড়া করতে আসে, রোজাদার বলবেন আমি রোজা রেখেছি।
রমজান সিয়াম সাধনার মাস। অভাবী মানুষেরও প্রত্যাশা থাকে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, যাতে তারা নির্বিঘেœ রমজান পালন করতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়। কিছু কিছু দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়েও দেয়া হয়, যেমন সৌদি আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে পণ্যের দাম কমিয়ে রোজাদারদের নির্বিঘেœ প্রশান্তি সহকারে সিয়াম সাধনার সুযোগ করে দেয়া হয়। সহমর্মিতার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও ক্রেতা সাধারণের হাতের নাগালে রাখা ও ওজনে কম না দেওয়া। ইসলাম শুধু অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম নয়। এর মূল বাণীই হচ্ছে মানবতার উৎকর্ষ, আল্লাহ্ ও রাসুলের আনুগত্য আর মানুষসহ সকল সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি ও ভালবাসা। পবিত্র রমজানে মুসলমানদের জীবন-জীবিকার সর্বত্র সততা, সংযম ও পবিত্রতার ছোঁয়া লাগবে এটাই স্বাভাবিক।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে মুনাফা করবেন তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রমজান মাসে ভোক্তাদের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অতিমুনাফা করবেন তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। প্রতি বছর, প্রতিমাস এবং প্রতিদিনেও জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থার উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী আরও জোরদার করতে হবে। দেশপ্রেম ও মানবিকতা এবং তাকওয়া সহকারে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করলে কোনো মানুষ অতি মুনাফা করার জন্য সচেষ্ট হবে না। রোজা সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারনগ! পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদের উপরও রোজা ফরজ করা হয়েছে। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (রোজা ফরজ করা হয়েছে) কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনের জন্য, (তারপরও) কেউ যদি সে (দিনগুলোতে) অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি (তখন) সফরে থাকে, সে ব্যক্তি সমপরিমাণ দিনের রোজা (সুস্থ হয়ে অথবা সফর থেকে ফিরে এসে) আদায় করে নেবে, (এরপরও) যাদের ওপর (রোজা) একান্ত কষ্টকর হবে, তাদের জন্য এর বিনিময়ে ফিদিয়া থাকবে (এবং তা) হচ্ছে একজন গরিব মানুষকে (তৃপ্তিভরে) খাবার দেয়া, অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি (এর চাইতে বেশি দিয়ে) ভালো কাজ করতে চায় তাহলে এ (অতিরিক্ত) কাজ তার জন্য হবে একান্ত কল্যাণকর, তবে (এ সময়) তোমরা যদি রোজা রাখতে পারো তাই তোমাদের জন্য ভালো, তোমরা যদি রোজার উপকারিতা সম্পর্কে জানতে (যে, এতে কি পরিমাণ কল্যাণ রয়েছে।) রোজার মাস (এমন একটি মাস), যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে আর এই কোরআন (হচ্ছে) মানব জাতির জন্যে পথের দিশা, সৎপথের সুষ্পষ্ট নিদর্শন, (মানুষের জন্য হক বাতিলের) পার্থক্যকারী। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে, সে এতে রোজা রাখবে, (তবে) সে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে, সে পরবর্তী (কোনো সময়ে) গুনে গুনে সেই পরিমাণ দিন পূরণ করে নেবে (এ সুযোগ দিয়ে) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের (কোরআনের মাধ্যমে জীবন যাপনের যে পদ্ধতি শিখিয়েছেন তার জন্যে তোমরা তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করো’ (সুরা বাকারা: ১৮৩-১৮৫)। একমাস সিয়াম সাধনা আর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পৃথিবীর মুমিন মুসলমানরা ঈমানী চেতনা জাগ্রত করে নেবে। সাহরী খাওয়া, তারাবীহ নামাজ পড়া, ইফতারী খাওয়া ও বিভিন্ন ইফতার পার্টির আয়োজন হবে। মসজিদে মসজিদে নামবে মুসল্লিদের ঢল। অনেকেই তাদের ‘জাকাত’ আদায় করবেন, অসচ্ছল মানুষদের বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্য সামগ্রী বিতরণ করবেন এবং বাড়তি আমল করার চেষ্টা করবেন। সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম এক আবহ বিরাজ করবে পুরো রমজান মাসে। পবিত্র রমজান মাসে পাল্টে যাবে মানুষের যাপিত জীবনধারা।
রোজার মাধ্যমে সংযম সাধনায় প্রকৃত লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। আর তাকওয়া অর্জন করলেই সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায় অবিচার দূর হবে। সমাজ হবে অপরাধমুক্ত ও দূর্নীতিমুক্ত। আদর্শ সমাজ গঠনের প্রধান শর্ত হচ্ছে মানুষের আত্মশুদ্ধি। মানুষের অন্তরাত্মা যখন কদর্যমুক্ত হবে তখনই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনো মানুষের মধ্যে যদি খোদাভীতি ঢুকে পড়ে, তখন সে মানুষ অপরাধ করতে পারে না। রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, কারণ রমজানের রোজাগুলো মানুষ একমাত্র আল্লাহর ভয়েই রাখে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই লোক চক্ষুর অন্তরালে পানাহার করতে পারে এবং অন্য মানুষের সামনে নিজেকে রোজাদার বলে প্রকাশ করতে পারে কিন্তু প্রকৃত রোজাদার তা করে না। তার একমাত্র কারণ এ রোজাদারগণ আল্লাহর ভয়েই রোজা রাখেন। রোজার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে আল্লাহর প্রতি ভয় এবং তাকওয়া অর্জিত হয় তা যদি সারা বছর বিদ্যমান থাকে তাহলে এ মানুষের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। রোজা মানুষকে মিথ্যা বর্জন করে ও সত্য বলতে অভ্যস্ত করে। কারণ রোজা রেখে মিথ্যা কথা বললে রোজার মাধ্যমে কোনো প্রকার ফায়দা পাওয়া যায় না। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং সে অনুসারে কাজ করা বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনের আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নাই। অনেক অপরাধের মূলেই দেখা যায় অবাধ যৌনাচার। রোজা অবৈধ যৌনাচার দমনেরও প্রশিক্ষণ। রসুল (সা.) বলেছেন, হে যুব সমাজ, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে। আর যারা বিয়ে করতে অক্ষম তারা যেন রোজা রাখে। কারণ রোজা তার যৌনক্ষুধা দমন করবে। অনেক সময় ধর্মহীনতা থেকেও বহু অন্যায় অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। সত্যিকার অর্থে রোজা ধর্মেরও প্রশিক্ষণ।
রমজান মাসে আল্লাহভীতির গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষের পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পায়। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন, জীবসত্তা যা দ্বারা প্রবল হয়, সেসব রিপুকে অবদমন করে রূহের শক্তিকে বৃদ্ধি করা হচ্ছে রোজার সাধনা। রমজান ত্যাগ ও সংযমের মাস, সমবেদনা ও সংযমের মাস। রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের মাস। মহানবী (সা.) বলেছেন, প্রতিটি জিনিসের যাকাত রয়েছে। শরীরের যাকাত হলো রোজা। রমজান মাস শুধু কোরআন নাজিলই নয়, রমজান মাসের প্রথম তারিখে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর উপর সহীফা অবতীর্ণ হয়। ছয় তারিখে মুসা (আ.)-এর উপর তাওরাত, ১২ তারিখে দাউদ (আ.)-এর উপর জবুর কিতাব ও ১৩ তারিখে ঈসা (আ.)-এর উপর ইনজিল কিতাব অবতীর্ণ হয়।
হাদিস শরীফে আছে, পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে ধর্মের মাস। পবিত্র রমজানের দীর্ঘ এ মাসে তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত ও আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভব। রোজাকে সামনে রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে সরকারকে অবিলম্বে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টি.সি.বি.-কে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আইন রয়েছে। বিদ্যমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অনেক পরিদর্শক দল রয়েছে। এসব তদারকি দল বাজার পরিদর্শন করলে ভোক্তারা উপকৃত হবে। জেলা প্রশাসনকেও রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করলে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতির একটি সূত্র হলো, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যত কম পণ্যের দাম বাজারে তত বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কাজটি কঠিন হলেও ভোক্তাদের স্বার্থে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। টি.সি.বি.’র কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে ন্যায্য মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারে সেজন্য রেশন কার্ড সরবরাহ করে রেশনিং প্রথা চালু করা যেতে পারে। আসন্ন রমজানে তেল, চিনি, ছোলা সহ নিত্যপণ্যের দাম যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রমজানে যাতে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে তাও তিনি নিশ্চিত করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহবান রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এ ব্যাপারে বাজার মনিটরিং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক উদ্যোগ দেশবাসী দেখতে চায়। বাজার মনিটরিংয়ে সরকারের আরও কঠোর হতে হবে। রমজান মাসে ইফতারি ও সেহরীতে ব্যবহৃত খাদ্যপণ্যকে ভেজালমুক্ত রাখতে সরকারের তদারকি কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
সত্যিকার অর্থে দেশে বিদ্যমান সকল আইনি ব্যবস্থা সরকারকেই কার্যকর করতে হবে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যে সমস্ত মুসলমান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে তারা যেন তাদের অধিকারের পূর্ণ প্রয়োগসহ ন্যায্যমূল্যে ও ভেজালমুক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে পারেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সে ব্যাপারে আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন