কবি কাদের নওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি পড়েছিলাম প্রাইমারীর ছাত্র থাকা অবস্থায়। কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছিলেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব তার পুত্রের শিক্ষককে কী উঁচু মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন। আওরঙ্গজেব একদিন দেখলেন, তার পুত্র একটি পাত্র দিয়ে পানি ঢালছে, আর তার শিক্ষক নিজ হাতে পা কচলে পরিষ্কার করছেন। সম্রাটের এ দেখার বিষয়টি শিক্ষকও দেখে ফেললেন। তিনি খুব ভয় পেয়ে গেলেন। সম্রাটের পুত্রকে দিয়ে পানি ঢালিয়ে তিনি যে অপরাধ করেছেন, তার শাস্তি কী হয়, তা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলেন শিক্ষাগুরু। পরদিন সম্রাটের দরবারে ডাক পড়ল তার। এবার বুঝি গর্দানটাই যায়- ভেবে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি সম্রাটের দরবারে হাজির হলেন। সম্রাট গুরুজীকে অবাক করে দিয়ে বললেন, গতকাল দেখলাম আমার পুত্র পানি ঢালছে, আর আপনি নিজে পা পরিষ্কার করছেন। কেমন শিক্ষা দিয়েছেন আপনার ছাত্রকে? সে কেন নিজে হাতে আপনার পা পরিষ্কার করে দিল না? সে সময় শিক্ষকের অনুভ‚তি কবি কাদের নওয়াজ প্রকাশ করেছিলেন এভাবে-‘আজি হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর!’ একজন শিক্ষকের মর্যাদা বোঝাতে কবিতার ওই দু’টি লাইনই কি যথেষ্ট নয়? সমাজে শিক্ষকের অবস্থান ও মর্যাদা অনেকের ওপরে। ব্যক্তিজীবনে একজন মানুষের বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকের অবস্থান। ফলে একজন শিক্ষক হন পিতৃত‚ল্য। তারা হন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও তাদেরকে সমীহ করেন । এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলার দরকার করে না। একজন শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জ্বেলে দেন জ্ঞানের আলো, দিকনির্দেশনা দেন সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে। একমাত্র অকৃতজ্ঞ ও অমানুষ ছাড়া কেউ তাদের শিক্ষকের কাছে ঋণের কথা অস্বীকার করতে পারে না। মহাবীর আলেকজান্ডার তার শিক্ষক দার্শনিক এ্যারিষ্টটল সম্পর্কে বলেছিলেন,‘ টু মাই ফাদার আই অও মাই লাইফ, টু এ্যারিষ্টটল, হাউ টু লিভ ওয়ার্থলী’- অর্থাৎ আমি আমার জন্মের জন্য পিতার কাছে ঋণী, আর কীভাবে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হয়, সে শিক্ষার জ্যন্য এ্যারিষ্টটলের কাছে ঋণী’। আলেকজান্ডারের এ উক্তি থেকেই একজন মানুষের জীবনে তার শিক্ষকের ভ‚মিকার কথা অনুমান করা যায়।
কিন্তু শিক্ষকের সে মর্যাদা বা সম্মানের স্থানটি যেন সাম্প্রতিককালে নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, শিক্ষক নামধারী কতিপয় অসৎ মানুষের ক্রিয়াকলাপ শিক্ষকের সে মর্যাদাকে ভ‚লুণ্ঠিত করতে উদ্যত হয়েছে। বিশেষ করে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ-দৌলার জিঘাংসার শিকার ওই মাদ্রাসারই শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা এ প্রশ্নকে বড় করে তুলেছে। যে প্রশ্নটি আজ সবার মুখে তা হলো- পিতার বয়সী একজন শিক্ষকের কাছে যদি একজন কিশোরী ছাত্রী নিরাপদ না থাকে, তাহলে আমরা কোথায় যাবো? ঘটনার বিবরণ সবারই জানা। তাই এখানে তার পুনরুল্লেখ করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। তবে, এটা বলা দরকার যে, সিরাজ যে নৃশংস কাজটি করেছে, তাতে গোটা শিক্ষক সমাজের ভাবমর্যাদা কালিমালিপ্ত হয়েছে।
কিশোরী নুসরাত সিরাজ-উদ-দৌলার লালসার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। কিন্তু লালসা চরিতার্থ করতে না পেরে সে হিং¯্র হয়ে উঠে। সঙ্গে সহযোগী হিসেবে পেয়েছিল স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিটিকে। শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলার আসামী হিসেবে কারাগারে গেলেও অন্তর্জ্বালায় জ্বলছিল সিরাজ। কীভাবে অপমানের প্রতিশোধ নেয়া যায় সে চেষ্টায় রত হয়েছিল সে। নুসরাতকে চরম শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার দুইদিন আগে অর্থাৎ ৪ এপ্রিল কারাগারেই পরামর্শসভা করেছিল তার স্যাঙাতদের সাথে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় নুসরাতকে পুড়িয়ে মেরে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার। সে পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন হয় ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা সংলগ্ন সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে। কেরসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় নুসরাতের শরীরে। বাস্তবায়িত হয় সিরাজ মাওলানার ঘৃণ্য পরিকল্পনা।
গণমাধ্যমের খবর থেকে এটা পরিষ্কার যে, নুসরাতের ওপর চরম প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে সিরাজকে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশ এবং সোনাগাজী থানার সদ্য প্রত্যাহৃত ওসি মোয়াজ্জেম। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা রুহুল আমিন এবং মাকসুদ ছিল ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। কারণ পিআইবি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, নুসরাতের গায়ে আগুন লাগানোর পর অপরাধী শাহাদত হোসেন শামীম প্রথমেই মোবাইল ফোনে ঘটনা জানিয়েছিল রুহুল আমিনকে। মাওলানা সিরাজের পরিকল্পনা মোতাবেক নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার অপারেশনে সবচেয়ে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছে শামীম ও নূরুদ্দিন। এরা দুইজনই নুসরাতের কাছে প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু সে দুইজনকেই ফিরিয়ে দিয়েছিল। প্রেম প্রত্যাখ্যাত দুই বিকৃত মানসিকতার যুবক ও ললসা চরিতার্থ করতে ব্যর্থ অধ্যক্ষ সিরাজের প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল একটি জীবন।
মানুষ বিশ্বাস করবে কাকে? পিতৃতুল্য শিক্ষক যদি ছাত্রীর ইজ্জত হরণে উদ্যত হয়, থানার বড় কর্মকর্তা যদি হয় সে অপরাধীর সহযোগী, আর দেশ ও মানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গের শপথ নেয়া রাজনৈতিক নেতারা যদি নিজেরাই মানুষের হন্তারক হয়ে ওঠে, তাহলে মানুষের যাবার জায়গা কোথায়? ইন্সপেক্টর মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গত ১৫ এপ্রিল ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শ্লীলতাহানির মামলার পর সে নুসরাতকে থানায় নিয়ে যেভাবে অশ্লীল কায়দায় জেরা করেছে এবং সে জেরার দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে ইণ্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি যে, মোয়াজ্জেম সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহৃত হলেও এখনও চাকরিতে বহাল আছে। এত বড়ো একটি অপরাধের প্রমাণ পাবার পরও কেন তাকে এখনও চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে না তাও রহস্যময় ব্যাপার।
সোনাগাজীর সিরাজ মাওলানার মতো আরো অনেকেই আছে আমাদের সমাজে। তারা শুধু শিক্ষক সমাজের ভাবমর্যাদাই ক্ষুন্ন করছে না, কলুষিত করছে আমদের সমাজকেও। তারা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিচয়ে অবস্থান করছে। পরিচয় ভিন্ন হলেও প্রকৃতগতভাবে তারা এক ও অভিন্ন। এক্ষেত্রে ভিকারুননিসার শিক্ষক পরিমল আর সোনাগাজীর সিরাজ মাওলানার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। শিক্ষকদের মধ্যে একটি অংশের মূল্যবোধের এমন অবক্ষয়ের বিষযটি সমাজ সচেতন মানুষদের ভাবিয়ে তুলেছে। কেননা, আগামী প্রজন্ম তথা দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের ‘মানুষ’ করে তোলার গুরুদায়িত্ব যাদের ওপর ন্যাস্ত, তারাই যদি নিকৃষ্টতার উদাহরণ সৃষ্টি করে, তাহলে ভবিষ্যত ভেবে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আজ একই চিত্র। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কতিপয় শিক্ষক প্রায়ই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয় এ ধরনের অপকর্মের জন্য। কোথাও নোট দেয়ার নামে ডেকে নিয়ে, কোথাও পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে কতিপয় নরাধম শিক্ষক তাদের লালসার শিকারে পরিণত করে ছাত্রীদের। বলা হয়ে থাকে, সাদা কাপড়ে কালির দাগ খুবই স্পষ্টভাবে দেখা যায়। একজন অশিক্ষত লোক, যার নীতিজ্ঞান নেই, কিংবা একজন পেশাদার অপরাধী যে কাজটি করে, সে একই কাজ যদি একজন শিক্ষিত, বিবেকবান এবং শিক্ষাদানে নিয়োজিত ব্যক্তি করে তাহলে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে কী? সমস্যা আরো আছে, এক সিরাজ মাওলানার কারণে গোটা আলেম সমাজ আজ ভাবমূর্তি সঙ্কটের মুখোমুখি। এক সিরাজকে উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশের গোটা আলেম সমাজের চরিত্র হননে কোনো গোষ্ঠী মেতে ওঠে কিনা-সে শঙ্কাও রয়েছে। কেননা, এরই মধ্যে চাঁদপুরের একটি গ্রামে এক মসজিদের ইমামকে তিন তরুণীর মারধরের ঘটনা আমরা জেনেছি। এখানেও ইমাম কর্তৃক তরুণীকে উত্যক্ত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এখন শত্রুতা উদ্ধার করার জন্য যদি কেউ এ ধরনের অভিযোগ তুলে কাউকে হেনস্তা করতে চায়, তাহলে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। অস্বীকার করা যাবে না, ইদানীং আমাদের শিক্ষক সমাজের একটি অংশ নৈতিকতাহীন কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধা করছে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামের প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বিরাজমান। এর জন্য অনেকেই শিক্ষক-রাজনীতিকে দায়ী করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তারা পদ-পদবী, পদোন্নতিসহ নানা স্বার্থের কারণে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়। আর গ্রাম পর্যায়েও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় টাউট-বাটপার মিলে গড়ে তোলে সিণ্ডিকেট। সে সিণ্ডিকেট এটাই মজবুত যে, তা ভাঙা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। সিণ্ডিকেটের সদস্যরা একে অপরের বিপদে সাহায্যকারীর ভ‚মিকায় নামে। গোষ্ঠীস্বার্থে তারা হয়ে যায় একাট্টা। সোনাগাজীর সিরাজ মৌলভীও তেমনি একটি সিণ্ডিকেটের সদস্য। ফলে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নোতারা যেমন তাকে অপকর্মে সহযোগিতা করেছে, তেমনি সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে।
আমরা আমাদের শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষক পেয়েছি । তখন তাদের সম্পর্কে এ ধরনের কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। আসলে আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থাই যেন কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র দৃশ্যমান। আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে অনেকেই ভুলে যায় নীতি-নৈতিকতা ন্যায়-অন্যায়ের কথা। আজ একজন সিরাজের কারণে দেশের গোটা আলেম সমাজ লজ্জায় অধোবদন। শিক্ষক সমাজও লজ্জিত। এ লজ্জা আমাদের সবার। কারণ আমরা আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি।
তারপরও কথা আছে। একজন সিরাজ মৌলভী বা পরিমল গোটা আলেম বা শিক্ষক সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়। গুটিকয় অমানুষ ছাড়া বাকিরা এখনও নিয়োজিত আছেন ভবিষ্যত নাগরিকদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার মহানব্রতে। তারাই শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি। তারা শ্রদ্ধার পাত্র। এজন্য সিরাজের মতো দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। আর যেনো কোনো নুসরাতকে নারীলোভী কোনো হায়েনার নৃশংসতার শিকার হতে না হয়, সেজন্য সোচ্চার হতে হবে সবাইকে। এক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব বিরাট। সম্রাট আওরঙ্গজেব একদিন শিক্ষাগুরুকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন, তারা যেন সে আসনেই অধিষ্ঠিত থাকেতে পারেন। শিক্ষাগুরুর সে উঁচু শির যেন সদা সমুন্নত থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব সবার।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন