শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিনিয়োগমন্দা, বেকারত্ব ও বিশাল বাজেট

প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বেসরকারী থিংক ট্যাঙ্ক দি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ মন্তব্য করেছে যে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সংখ্যা কমে গেছে। অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার যত বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থানের বা চাকরি-বাকরির সংখ্যাও তত বাড়বে। সরকার দাবি করছে যে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে অন্তত ৭ শতাংশ। সরকারের এই দাবী নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সিপিডি’র মতে, সাম্প্রতিক ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির হার যে ৬ শতাংশের বেশী সেই ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ বা তার বেশী থাকলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। এটি উন্নয়ন অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই থিওরি খাটছে না। এখানে উন্নয়নের হারের সাথে সাথে কর্মসংস্থানের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সিপিডি যে পরিসংখ্যান দেয় সেখান থেকে দেখা যায় যে, ২০০২-২০১৩ এই এগারো বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার ভাল। প্রতি বছর ১৩ লক্ষ ৬০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৩ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত কর্মসৃষ্টির হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। প্রতি বছর সৃষ্টি হয়েছে ৩ লক্ষ কর্মসংস্থান। অন্যকথায় প্রতি বছর ১০ লাখ মানুষ নতুন চাকরি-বাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধুমাত্র ম্যানুফ্যাচারিং খাতে বিগত ২ বছরে ১২ লক্ষ কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং আমরা যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলি, তখন শুধু কয়েকটি অংকের পরিসংখ্যান অর্থাৎ ৫ শতাংশ, ৬ শতাংশ বা ৭ শতাংশের মতো সংখ্যাতত্ত্ব দিলেই উন্নয়নের জোয়ার আসে না। যদি নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি না হয় অথবা কর্মসংস্থানের পরিমাণ হ্রাস পায়Ñ তাহলে সেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণের কোনো কল্যাণ হয় না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে রয়েছে বেসরকারী বিনিয়োগ এবং কর আরোপ ও রাজস্ব সংগ্রহের প্রশ্নটি। জিডিপি’র অংশ হিসেবে বেসরকারী বিনিয়োগের হার যত বাড়বে অর্থনৈতিক উন্নয়নও তত বৃদ্ধি পাবে। ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিলো। তার পর থেকে এই দু’টি খাতেই নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
বেকারত্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বিগত ৩ বছরে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বিশেষ করে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে, তাদের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক দিন আগে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, দেশের সামগ্রিক বেকারত্বের মধ্যে শিক্ষিত বেকারদের হার ৪৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যানে বেকারত্বের যে চিত্র ফুটে উঠেছে সেটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিগত ৩ বছরে অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষ চাকরি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সহজ নয়। এখান থেকে পরিত্রাণের একটি মাত্রই পথ রয়েছে। আর সেটি হলো, সরকারী ও বেসরকারী উভয় খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো অপ্রতুল বিনিয়োগ। শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। সেই বিনিয়োগের ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কর্মীরা উৎপাদন করবে এবং দেশ সমৃদ্ধির সোপানে আরোহণ করবে। এমন একটি পটভূমিতে সরকার প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকার বিশাল বাজেট আগামী অর্থ বছরের জন্য পেশ করতে যাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। এই বাজেটে ভ্যাট আরোপের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে বলে প্রকাশ। সিপিডিসহ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, যেরূপ ঢালাওভাবে সরকার ভ্যাট আরোপ করতে যাচ্ছে তার ফলে সব জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যেই প্রতিটি জিনিসের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তার মধ্যে যদি আবার সকলকে ভ্যাটের আওতায় আনা হয়, তাহলে সেটি হবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষদের বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো। ভ্যাট থেকে ইতোমধ্যেই মানুষের অভিজ্ঞতা হয়েছে বড়ই তিক্ত। ইতোপূর্ব দেখা গেছে যে, যারা উৎপাদন করে অথবা যারা সেবা খাতে সেবা প্রদান করে শুধুমাত্র তাদের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে, ঐসব উৎপাদক এবং সেবাদানকারীরা ভ্যাটের বোঝা নিজেদের কাঁধ থেকে নামিয়ে চূড়ান্ত পরিণামে সাধারণ মানুষদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা আগেই বলেছি যে, এমন নির্বিচারে যদি সকলের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়, তাহলে জিনিসপত্রের দাম এতো বেশী বাড়বে যে, তার ফলে চূড়ান্ত পরিণামে দেশে সৃষ্টি হবে গণঅসন্তোষ। সেই গণঅসন্তোষ যদি জন বিস্ফোরণে রূপ নেয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রতি বছর দেখা যাচ্ছে যে, সরকার বিশাল আকারের বাজেট দেয়। তারপর বছর শেষ হওয়ার দু’য়েক মাস আগে দেখা যায় যে, সেই বাজেটের ৭০ শতাংশও বাস্তবায়িত হয়নি। তখন সংশোধনের নামে বাজেট মারাত্মকভাবে কমানো হয়। বাজেটের আকার বেশী করে কাটছাঁট করা সরকারের একটি নিয়মিত ফিচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বড় বড় উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো আর শেষ হয় না। বেসরকারী খাতে দেখা যায়, বিশাল আকারে রাজস্ব আদায়ের ওপর নির্ভর করে বিশালায়তন বাজেট করা হয়। কিন্তু বছরের শেষ প্রান্ত থেকে দেখা যায়, কর আদায়ে বিশাল ঘাটতি পড়েছে। ফলে রাজস্ব বাজেটও ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করতে হয়। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও সরকার এবারেও বিশাল আয়তনের বাজেট দিতে যাচ্ছে। সিপিডিসহ অনেকেই বাজেটের আয়তনকে বাস্তবায়নের অযোগ্য বলে মনে করছেন। তাই তারা এমন বাজেট চান না যে বাজেট বছর শেষে ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করতে হয়। সে কারণেই আজ সুস্থ সচেতন মানুষের বক্তব্য হলো, বিশাল বাজেট পেশ করা কোনো ক্রেডিট নয়, বরং অপেক্ষাকৃত ছোট বাজেট, যেটি পুরাপুরি বাস্তবায়ন করা যাবে, সেই ধরনের বাজেট সাধারণ মানুষের কাম্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন