শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণহত্যা ও গণতন্ত্র বিরোধিতার চেপে রাখা ইতিহাস এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পতন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

পশ্চিমা পুঁজিবাদী অ্যাম্পায়ার ক্রমেই একটি গভীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা ক্রমশ: আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ছে। এক সময় বৃটিশ সাম্রাজ্যে নাকি সূর্য অস্ত যেত না। ইউরোপ আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় বিস্তৃত সাম্রাজ্যের কোথাও না কোথাও সূর্য দেদীপ্যমান থাকতোই। বিংশ শতকের গোড়ায় এবং মধ্যভাগে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটিশ সাম্রাজ্যের জন্য পতন না হলেও সেই বিজয়ের মূল অনুঘটক হিসেবে মার্কিন নিওকন ও জায়নবাদিদের উত্থান ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন বিশ্বব্যবস্থার আওতায় যে মার্কিন পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা এখন গর্বিত টাইটানিকের মত আটলান্টিকের অতল গভীরে ভরাডুবির মত তলিয়ে যেতে বসেছে। মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে বিশ্বের মানুষের জন্য যে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির বার্তা দিয়েছিলেন, তা এখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিংশ শতকের শুরুতে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পত্তন সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতিদ্বন্দি ও হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে মার্কিন রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাংকাররা। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের ফ্যাসিবাদের হুমকির মুখে রাশিয়া-আমেরিকা সব রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে জাতিসংঘকে একটি একক সাংগঠনিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যে নতুন শান্তির বিশ্ব গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল তা কাজে লাগানো যায় নি। বিশ্বকে দুইটি বলয়ে বিভক্ত করে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত জিইয়ে রেখে অস্ত্রবাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ফায়দা হাসিলের ঘৃন্য অপচেষ্টা বিশ্বব্যবস্থার জন্য ধ্বংস ডেকে এনেছে। বৃটিশ ইম্পেরিয়ালিজমের ভগ্না¦বশেষের উপর একসময় যে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব এখন তারও পতনের সাক্ষী হতে চলেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পাদপীঠ লন্ডন, প্যারিস ও ওয়াশিংটনে সে পতনের ছায়া ক্রমে দীর্ঘতর হচ্ছে। পশ্চিমা মানবতাবাদী ও উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা বহুদিন ধরেই তার পূর্বাভাস দিয়ে আসছেন। বৃটিশ রাজনীতিবিদ জর্জ গ্যালওয়ে দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের উপর পশ্চিমা ও জায়নবাদী ইহুদিদের অন্যায় আচরণ, নৃশংস সামরিক আগ্রাসন ও যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। গত জানুয়ারীতে প্রকাশিত গ্যালাওয়ের লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ফল অব অ্যাম্পায়ার: লন্ডন, প্যারিস, ওয়াশিংটন অন ব্রিঙ্ক অব কলাপ্স। মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ন্যাটো জোটের সামরিক তৎপরতা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, দখলবাজি ও আগ্রাসনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এই পতনের আয়োজনই প্রকাশ্য রূপ লাভ করতে শুরু করেছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর একচেটিয়া অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া এবং কোরীয়যুদ্ধ, ভিয়েতনামযুদ্ধ এবং নব্বই দশকের শুরুতে ইরাকের কুয়েত দখলকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া গাল্ফ ওয়ার এবং পরবর্তীতে নিউইয়র্কে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সূচিত ওয়ার অন টেররিজমের ধারাবাহিকতায় একের পর এক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দখল, অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করে দেয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের দেউলিয়াত্ব ও ধ্বংসাত্মক চেহারা বিশ্বের সামনে ফুটে উঠে।
আজকের বিশ্ববাস্তবতায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে একদিকে বেইজিং, মস্কোর যুগপৎ এগিয়ে চলা অন্যদিকে লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস ও ওয়াশিংটনে নজিরবিহীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, জনঅসন্তোষ ও পুরনো সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলো ধসে গিয়ে অসন্তোস, অনাস্থা ও অসহিষ্ণুতার উত্তাপ ক্রমে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতাধিক শহরে নির্বাচনী অনিয়ম-অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে সে দেশের লাখ লাখ মানুষ। তারা ট্রাম্পের মত চরম বর্ণবাদী ব্যক্তির অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচত হওয়ার বাস্তবতাকে মেনে নিতে রাজি হয়নি। তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে পশ্চিমা বিশ্বের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের রাজনৈতিক দাবী স্থায়ীত্ব লাভের সুযোগ কম থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্বাচনের পর এ ধরনের বিক্ষোভ ও দাবী সম্ভবত এটাই প্রথম। মার্কিন অর্থনীতিতে জনগণের স্বার্থরক্ষার চেয়ে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার প্রাধান্য থেকেই মার্কিন গণতন্ত্র ভেতর থেকে দুর্বল ও ফোঁকলা হয়ে পড়েছে। কর্পোরেট স্বার্থের অনুগামী পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি জনস্বার্থের চেয়ে কর্পোরেট স্বার্থেই সদা তৎপর থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতকিছুর পর অর্থনৈতিক ধস বা রিসিশন ঠেকানো যায় না, যখন দেখা যায় বহুদিনে দেশের বেশীরভাগ সম্পদ কিছু সংখ্যক কর্পোরেট পুঁজিপতির হাতে জমা হয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সম্পদ পশ্চিমাবিশ্বে পুঞ্জিভ‚ত হওয়ার পরও সেখানে মানুষের আয়বৈষম্য বেড়ে যাওয়া, এই পুঁজিপতিদের মুনাফাবাজির খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়া, কর্মহীন, বাস্তুহীন আশাহত মানুষ তখন রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। গত দশকের শেষদিকে পশ্চিমে অর্থনৈতিক মন্দার সময় নিউ ইয়র্কের রাস্তার নেমে আসা হাজার হাজার মানুষের একটি জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল ‘উই আর ৯৯.৯ পারসেন্ট’। এর মানে হচ্ছে, ৯৯.৯ ভাগ মানুষের সম্পদ শোষণ করছে সমাজের অতি ক্ষুদ্র অংশ, যাদের সংখ্যা শতকরা একভাগেরও অনেক কম। এই নিরানব্বই ভাগ মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসন করছে একভাগেরও কম অংশের প্রতিনিধিরা। শুধু শাসনই করছে না, নিরানব্বইভাগ মানুষ তাদের অধিকার ও দাবী-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেও পারছেনা। দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, কর্পোরেট মিডিয়া কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে কথা বলছে না। এই বাস্তবতা শুধু পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতির পতনের বড় কারণ হয়েই দাঁড়ায়নি, সেই সাথে পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং তার উদারনৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংসেরও কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের গ্যাড়াকলে আটকে থাকা মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশগুলোও এর দ্বারা আরো বেশী প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কনজিউমারিজমের খপ্পরে পড়া ভোগবাদী সমাজ এক সময়ের কৃষি ও শিল্পবাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতির প্রতিযোগীতায় চীন-রাশিয়াসহ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দি দেশগুলোর সাথে যখন পরাজিত হতে চলেছে, তখন রিজিম চেঞ্জ, অস্ত্রবাণিজ্য ও যুদ্ধের অর্থনীতিই পশ্চিমাদের শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কনভেনশন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কুকুর লেজ নাড়ে নাকি লেজ কুকুরকে নাড়ায়’ এমন প্রশ্ন নানা ক্ষেত্রে শোনা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যকার সম্পর্ক ও প্রভাব সম্পর্কে এই ফ্রেজ অনেকটাই যথোপযুক্ত বলে গণ্য হচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফিলিস্তিন ও আরব প্রতিবেশীদের সাথে ইসরাইলের ভ‚মিকার প্রশ্নে বিশ্বসম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের প্রেক্ষাপটে ইউনেস্কো, আইসিসির মত সংস্থা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলা যায়। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়ার যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলছে তার সূচনাও সম্ভবত বিশ্বব্যবস্থার উপর তার অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ব্যর্থতা ও সংশয় থেকে। অন্যদিকে ইউরোীয় রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের পাদপীঠ প্যারিসেও নজিরবিহীন অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছে। একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা এবং সবর্শেষ ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে যে উন্মাতাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সবদিক অন্ধকার হয়ে আসার বাস্তব লক্ষণ মাত্র। এ ক্ষেত্রে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে পশ্চিমা গণতন্ত্র ও সভ্যতার বিপরীতে রাশিয়া বা চীনের মত নব্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিগুলো তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারছে না। পশ্চিমা পুঁজিতান্ত্রিক ভোগবাদী সাম্রাজ্যবাদ ইসলামকেই রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করছে। একসময় ইউরোপ দখল করার ইতিহাস এবং পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনসংখ্যা এবং মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে পশ্চিমাদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়ে পশ্চিমা আইন ও গণতান্ত্রিক মাল্টিকালচারালিজমের নীতি সরিয়ে নিয়ে বৈষম্য ও বিভেদ নীতি চালুর মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা এখন প্রকারান্তরে আত্মঘাতী পথ অনুসরণ করছে। এশিয়া-আফ্রিকা থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করে গড়ে তোলা পশ্চিমা সভ্যতা হঠাৎ করেই এমন ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলামোফোবিক হয়ে যায় নি। এ বিষয়ে ২০১৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে চেক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুবোমীর জাওরালেক বোমা ফাটানোর মত কিছু তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। শত বছরের ইতিহাসে পশ্চিমা সভ্যতা নিজেদের কায়েমী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে বিশেষত মুসলিম বিশ্বে যে সব গণহত্যা চালিয়েছিল ইতিহাসের সে সব ঘটনা সম্পর্কে এখনকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা (অধিশবহরহম) তৈরী হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন লুবোমীর। এ কথা পশ্চিমা বিশ্বের জায়নবাদী থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো জানে বলেই তারা ইসলামোফোবিক এজেন্ডা গ্রহণ করেছে। এ থেকে একদিকে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের উগ্রপন্থার জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে এই উগ্রপন্থাকে পুঁজি করে আল-কায়েদা ও আইএস’র মত সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর পেছনে গোপণেঅর্থ ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে প্রকাশ্যে ইসলামিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লুবোমীরের বক্তব্যে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে(১৮৫৭) ভারতে বৃটিশ বিরোধী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যার ঘটনা থেকে শুরু করে বৃটেন, ফ্্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম আমেরিকাও রাশিয়া ও সোভিয়েত সাম্রাজ্যকে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করার পাশাপাশি কঙ্গো, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যার ক্রনলজিক্যাল বিবরণ তুলে ধরেছেন তিনি। তার মতে, দীর্ঘদিন ধরে ধামাচাপা দিয়ে রাখা রাজনৈতিক স্মৃতি হঠাৎ করে জেগে উঠেছে। ইতিহাস ভুলে যাওয়া ও ধামাচাপা রাখার প্রবণতা একটি মারাত্মক আত্মঘাতী প্রবণতা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা সাজলেও মূলত তারাই বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের মূল প্রতিবন্ধক। গণতন্ত্র থাকলে শাসককে জনগনের দ্বারস্থ হতে হয়, জনগণের স্বার্থে, জনগণের অধিকারের প্রশ্নে কোনো শৈথিল্য বার আপোসকামিতা জনগণ কখনো মেনে নেয় না। এ কারণেই জনগণের বিপক্ষে গিয়ে বশংবদ রাজতন্ত্র, সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন দিয়ে তাদের মসনদ পোক্ত করার নীতি পশ্চিমাদের। জনগণের সম্পদ জনগণের স্বার্থে কাজে লাগানোর বদলে কর্পোরেট কোম্পানীর মাধ্যমে বিদেশী প্রভ‚দের হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে স্বৈরশাসকরা টিকে থাকার চেষ্টা করে থাকে। দেশে দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত রিজিম চেঞ্জ এজেন্ডার মূল লক্ষ্য সম্পদ লুন্ঠন এবং জাতিসমুহকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল করে রাখা। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে(১৯৫১) মধ্যপ্রাচ্যে ইরানে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর মোসাদ্দেক প্রথমেই ইরানের তেলসম্পদকে অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানীর খপ্পর থেকে বের করে এনে জনগনের স্বার্থে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেন। তিনি ইরানের তেল কোম্পানীকে জাতীয়করণ করেন। এতে বৃটিশরা ক্ষিপ্ত হয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজনৈতিক প্লট তৈরী করে। মার্কিন সিআইএ এবং বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত তৎপরতায় তেহরানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত করে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে পশ্চিমা বশংবদ পাহলবি রাজাদের ক্ষমতা পুন:প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিংশ শতকের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানিরা ১৯৭৯ সালে শাহের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। সেই থেকে ইরানে রিজিম চেঞ্জ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের একটি বড় এজেন্ডা হয়ে আছে। গত একশ বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতেম গিয়ে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেনিজুয়েলায় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অচলাবস্থা এবং কথিত সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যর্থ প্রয়াস এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক বিষয়। মার্কিন বশংবদ ও ক্রীড়নক গুয়াইদোকে ক্ষমতায় বসাতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রিয় মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার নানা ধরনের অভিসন্ধি চলছে কয়েক বছর ধরে। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে ভেনিজুয়েলায় অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে মার্কিন প্রশাসন সংকট নিরসনে সহায়তার বদলে এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে সেখানে রিজিম চেঞ্জের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মাদুরোকে সরিয়ে দিতে ব্যর্থতা নিশ্চিত জেনেই ভেনিজুয়েলায় মার্কিন সামরিক অপশনের কথা বলা হচ্ছে। মোসাদ্দেক থেকে মাদুরো গত সাড়ে ৬ দশকে বিশ্বের অনেক পরিবর্তন ঘটলেও পশ্চিমাদের গণতন্ত্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তবে বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্ব সম্প্রদায় শুধু আধিপত্যবাদী পরাশক্তির এসব অনৈতিক-অমানবিক কর্মকান্ডের নিরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে। একের পর এক দেশ ও জনপদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ পশ্চিমাদের এই ঘৃণ্য হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের স্বপক্ষে পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার মতলববাজির মিথ্যা প্রপাগান্ডায় বুঁদ হয়ে আছে। এ থেকে মুক্তির জন্য পশ্চিমা বিশ্ব থেকে তৃতীয়বিশ্ব পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস চেতনা ও গণজাগরণের আলামতও ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক-ওয়াশিংটনে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অস্থিরতা ও ভঙ্গুরতা বেড়ে চলেছে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন