রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মহাকালের চাকা ঘুরে পুনরায় আমাদের দ্বারে হাজির হয়েছে সিয়ামে রমজান। সিয়ামে রমজান এমন এক ইবাদত যা অন্যতম সুপরিচিত ইবাদত সালাত তথা নামাজের মতো কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ করা যায় না। মওসুম ভেদে এর স্থিতিকাল প্রতিদিন কম পক্ষে বার থেকে ষোলো ঘণ্টা করে পূর্ণ এক মাস এ ইবাদত পালন করতে হয় বলে এটাই ইসলামের দীর্ঘতম ইবাদত হিসাবে পরিচিত।
যে আয়াতে কালিমার মাধ্যমে এই ইবাদতের বিধান প্রবর্তিত হয় তাতে বলা হয়েছে, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তাদের উপর সিয়ামের বিধান প্রবর্তন করা হলো, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।
এই আয়াতের মাধ্যমে সিয়াম সম্পর্কে দুটি ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায়: (এক) অন্যান্য নবীদের আমলেও কোনো না কোনো ধরনে সিয়াম চালু ছিল। (দুই) সিয়ামের মূল লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন। অন্যান্য নবীও যেহেতু আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত, তাই তাদের আমলেও কোনো না কোনো ধরনের সিয়াম চালু থাকাটা স্বাভাবিক। এর পর বাকী থাকে শুধু তাকওয়া অর্জন প্রসঙ্গ।
তাকওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কণ্টকপূর্ণ পথে চলতে যেমন প্রতি মুহূর্তে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, তেমনি কষ্টকর জীবন পথে চলতে প্রতি মুহূর্তের জন্য সাবধানতার অভ্যাস গঠনই তাকওয়ার লক্ষ্য। এই সুকঠিন কাজে অভ্যস্ত করে তুলতেই সিয়ামে রমজান পালন করতে হয় দীর্ঘতম সময় ধরে, প্রতিদিন পনেরো, ষোলো ঘণ্টা ধরে। একটানা একমাস এ ইবাদত পালন করতে হয় বলে এক হিসাবে এটাই কঠিনতম ইবাদত।
কিন্তু আমরা সিয়ামের এই বৈশিষ্ট্যর বিষয়ে কতটা সচেতন থাকি? আমরা যে সিয়ামের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুব কমই সচেতন তা বলাই বাহুল্য। সিয়াম সম্পর্কে আমাদের ধারণা, রমজান মাসে সুবেহ সাদেক থেকে শুরু করে পরবর্তী দিন সূর্য অস্তকাল পর্যন্ত সর্ব প্রকার পানাহার বর্জন করে চলার নামই বুঝি সিয়ামে রমজান। তাই যদি সত্যি হতো তাহলে ইসলামের সুবর্ণ যুগে এক রোজাদারকে লক্ষ্য করে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা.) এমন কথা বলতেন না যে, ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া কোনই লাভ হচ্ছে না। অর্থাৎ তার সিয়াম আদায় হচ্ছে না!
এ কথার অর্থ হলো সিয়াম-পালনকারীকে সিয়াম পালন কালে অবশ্যই সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করে চলতে হবে। পরনিন্দা তো চলবেই না, কারো সাথে তুচ্ছতম কারণে ঝগড়া-ঝাটি বাঁধানোও চলবে না। কেউ যদি গায়ে পড়ে কোনো রোজদার ব্যক্তির সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি বাঁধাতে চেষ্টা করে, অত্যন্ত শান্ত মেজাজে তাকে বলে দিতে হবে আমি রোজা আছি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা কী দেখি?
রোজা থাকার দরুন দিনের একটা বড় অংশ ক্ষুধার্ত থাকার কারণে আমরা সেই সময়ে ক্ষুর্ধাত ব্যক্তি মাত্রই ক্রুদ্ধ ব্যক্তি (এ হাংগ্রি ম্যান ইজ অ্যান অ্যাংরি ম্যান) এই প্রবাদ বাক্যের সত্যতা প্রমাণে উঠে পড়ে লাগি। এরকম অবস্থায় আমরা যারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে রোজা পালন করি, তাদের রোজা কতটা সার্থক বা সফল হয় সেটাই প্রশ্ন। সুতরাং রোজা রেখে আমাদের রোজা কতটা সফল বা সার্থক করতে পারছি, তা আমাদের কঠিনভাবে বিচার করে দেখতে হবে। আমাদের অনেকের রোজাই যে ক্ষুৎ-পিপসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য।
সিয়ামে রমজান থেকে তাহলে কি আমাদের কোনো লাভই হয় না? আমাদের সিয়াম সম্পর্কে ধারণা থাকা সত্তে¡ও আমরা অনেকে যে হাসিমুখে আন্তরিকতার সাথে সিয়ামজনিত কষ্ট স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকি, তার কি কোনই মূল্য নেই? বিশেষ করে বাংলাদেশ একটি দরিদ্র মানুষদের দেশ বলে এদেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে মাহে রমজানের একটা সুপ্রভাব সহজেই পড়ে। দরিদ্র মানুষরা না খেয়ে অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত থাকতে অভ্যস্ত বলে মাহে রমজানে রোজা রাখতে তারা খুব কমই কষ্ট অনুভব করে। ফলে দেখা যায়, অনেকে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত না হলেও রমজানের পূরা মাস তারা ঠিকঠাক রোজা রাখে।
তবে সিয়ামে রমজানের মারফৎ সমাজ যেভাবে উন্নত হতে পারতো তা যে হচ্ছে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু আগেই আমরা বলেছি, সমাজের যারা দরিদ্র অংশ তাদের মধ্যেই সিয়াম পালন সীমাবদ্ধ রয়েছে, এ বাস্তবতা অস্বীকার করবার কোনই উপায় নেই। সমাজে যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে এগিয়ে তাদের অনেকেরই ধারণা, রোজা করবে গরিবরা, যাদের সারা বছরই অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। সমাজে যারা প্রাচুর্যের অধিকারী তাদের রোজা রেখে কষ্ট পাওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা প্রয়োজন বোধ করলে টাকা-পয়সা দান, খয়রাত করে গরিবদের সাহায্য করবে। অকারণে রোজা রেখে নিজেদের কষ্ট দেবে কেন?
আসলে সিয়ামে রমজান সমাজে যে মন-মানসিকতা সৃষ্টি করতে চায়, সে সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ উদাসীন। ইসলামের অধিকাংশ বিধানের মতো সিয়ামে রমজান ও সমাজের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। নামাজে আমরা ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের শিক্ষার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করি। সিয়ামে রমজানও তেমনি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য অবশ্যপালনীয়। আসলে ইসলাম নামাজের জামাতে যেমন ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চায়, তেমনি ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য সিয়াম অবশ্য পালনীয় ঘোষণা করে ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত পালন করতে আগ্রহী। এব্যাপারে কোনো অজুহাতে কোনো বিরোধিতা ইসলাম বরদাস্ত করতে রাজী নয়।
আসলে ইসলামের সকল বিধানের মধ্যেই তার মূল আদর্শ সাম্য-ভ্রাতৃত্বের প্রতিফলন রয়েছে। নামাজের কাতারে যেমন ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সাদা কালোর মধ্যে কোনো পার্থক্য স্বীকার করে না, ঠিক তেমনি সৎ পথে উপার্জন হালাল সম্পদের মধ্যেও অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রের অধিকার স্বরূপ জাকাতের বিধান রয়েছে। অনেকের ধারণা যেহেতু জাকাতের অভিধানিক অর্থ পবিত্রকরণ, তাই অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদ দরিদ্রকে দান করার নাম জাকাত। আসলে তা নয়। সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সৎ পথে অর্জিত সম্পদ একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছলে তার জন্য জাকাত আদায় অবশ্য পালনীয় হয়ে পড়ে। আসলে ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান হওয়ায় এর মধ্যে এমন কিছু নেই যাতে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে। এভাবে সমাজব্যবস্থা যদি এমন হয় যে, এক শ্রেণির ভাগ্যবানের হাতে সমাজের অধিকাংশ ধনসম্পদ জমা হয়ে পড়ে। অপরদিকে কিছু সংখ্যক লোক সীমাহীন দারিদ্রের কবলে পড়ায় তাদের জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখাই তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এ ধরনের ভারসাম্যহীন অবস্থা ইসলাম এক দিনের জন্যও মেনে নিতে অভ্যস্ত নয়। তাই জাকাত বিধানের মাধ্যমে ধনীর ন্যায় পথে অর্জিত অতিরিক্ত সম্পদ বিত্তহীনকে দিয়ে দিতে বাধ্য করে। ইসলামের এই বিধান শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। অর্থনীতি ছাড়াও ভাষা, বর্ণ, শ্রেণি, দেশ, জাতি সম্প্রদায় কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিশেষ ভাষা, বর্ণ, শ্রেণি, দেশ-জাতি বা কোনো সম্প্রদাকে বিশেষ অধিকার দিয়ে অন্যান্য ভাষা, বর্ণ, শ্রেণি দেশ, জাতি, সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করার পক্ষপাতী নয় ইসলাম। এই বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ইসলামের অভ্যুদয়ের স্বল্প সময়ের মধ্যেই ইসলাম সারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মাদর্শে পরিণত হয়।
দুঃখের বিষয়, পরবর্তীতে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে ইসলামের সোনালি যুগের আদর্শ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পৃথিবীতে ইসলাম বিরোধীশক্তি জোরদার হয়ে পড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তাদের ধ্বংসের শেষ প্রান্তে ঠেলে দেয়। এই পদ্ধতিতেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে এবং তারা বেছে বেছে মুসলিম দেশগুলোর উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী প্রভাব জোরদার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
অবশ্য সাম্রাজ্যজ্যবাদের এই প্রভাবও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। এক পর্যায়ে রাশিয়ায় এবং পূর্ব ইউরোপের কতিপয় দেশে কম্যুনিস্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করে তারা সাম্রাজ্যবাদের জন্য প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। এদিকে রাশিয়ার পর পর এক পর্যায়ে চীনেও এই আদর্শ ব্যাপক শক্তি অর্জন করে। ফেলতে সক্ষম হয়। ইতোমধ্যে অবশ্য বিশ্বের অনেক দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অন্যান্য বিশ্বশক্তির দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে এক নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়। বর্তমানেও সেই নাজুক অবস্থার অবসান হয়নি। ফলে বিশ্ব রাজনীতির শতধাবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বিশ্ব পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়। এই অনিশ্চিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা মাহে রমজানকে খোশ আমদেদ জানাই এই ভরসায় যে, যখন পৃথিবীতে কোনো আদর্শই বিশ্বশান্তির নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হচ্ছে না, সম্ভবত পৃথিবীতে ইসলাম পুনরায় তার হারিয়ে যাওয়া সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ নিয়ে ফিরে আসবে এবং বিশ্বকে তার বহুপ্রতীক্ষিত শান্তির পথে এগিয়ে নেবে।
এই পটভূমিতে আমরা মাহে রমজানের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছি এই আশা নিয়ে যে, সম্ভবত এই মাহে রমজানে বিশ্বে এমন কিছু ঘটবে, যার ফলে বিশ্বে ইসলামের পুনরুত্থান সম্ভব হবে। সেই অনাগত দিনের আশায় পবিত্র মাহে রমজানের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছি। খোশ আমদেদ মাহে রমজান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন