বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নজরুল জন্মবার্ষিকী আমাদের প্রাণের উৎসব

প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জাতীয় কবি নজরুলের ১১৭তম জন্ম বার্ষিকীতে রাষ্ট্র, সরকার এবং সব রাজনৈতিক পক্ষের অবহেলা নজরুল ভক্ত দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীকে হতাশ ও বেদনাহত করেছে। গত ২৫ মে থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ত্রিশালসহ নজরুল স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে নজরুল স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় সরকারের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, অনিচ্ছার ছাপ স্পষ্ট। সেই সাথে দেশের গণমাধ্যম বিশেষত সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও নজরুল জন্মোৎসব ঘিরে যৎসামান্য আয়োজন করেছে। তা’ও যেন দায়সারা গোছের। এ দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটি অংশকে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়, সেই সাথে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও যেভাবে সাজ সাজ রব তুলে রবীন্দ্র বন্দনায় মেতে উঠে, নজরুলের বেলায় দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান কবি। উভয়ের সাহিত্যকর্মই আমাদের কাছে অনন্য প্রেরণার উৎস। একজনকে খাটো করে আরেকজনকে বড় করার কোন সুযোগ নেই। তবে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী এবং মুক্তিকামী জাতীয় চেতনার কারণেই তিনি আমাদের জাতীয় কবি। গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক উত্থান থেকে শুরু করে আমাদের একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শিক আন্দোলনকে নজরুলের চেয়ে আর কেউ এতটা প্রভাবিত করতে পারেনি।
আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ এখন সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের শিকার। রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বে নীতি-নৈতিকতার চরম স্খলন পুরো জাতিকেই এক ধরেেনর অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করার দাবীও জোরালোভাবে উঠে আসতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে নজরুলের সাহিত্য, চিন্তাধারা ও জীবনদর্শনের সাথে নতুন প্রজন্মের পরিচয় ও শিক্ষাকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করার দাবীও অবধারিতভাবেই এসে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই দাবী ও আকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করে দিনকে দিন নজরুলের সাহিত্য ও শিক্ষা থেকে আগামী প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রাখার একটি প্রচ্ছন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারী ব্যবস্থাপনায় জাতীয়ভাবে নজরুল জন্ম-জয়ন্তীকে যেনতেন বা দায়সারাভাবে পালনের বাস্তব চিত্র জাতির সামনে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এবারের নজরুল জয়ন্তীতে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচে বেশী সরকারী মহলের অবহেলা ও অনিচ্ছার চিত্র দেখা গেছে। ঢাকায় জাতীয় কবির কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন, চট্টগ্রামে জাতীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নজরুল জন্ম-জয়ন্তীর উৎসব উদ্বোধন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ত্রিশালে দরিরামপুর নজরুল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত তিনদিনের অনুষ্ঠানমালায় একই রকমের হতাশাজনক চিত্র পাওয়া গেছে। ঢাকায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা বা কোন জাতীয় নেতাকে নজরুলের সমাধিতে বা র‌্যালিতে অংশ নিতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানটি প্রেসিডেন্টের উদ্বোধনের কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখানে যাননি। ত্রিশালে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনিও সেখানে উপস্থিত হননি।
জাতীয় কবি, সাম্যের কবি নজরুলের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সরকারী অবহেলার বিরুদ্ধে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ সর্বদাই সোচ্চার। ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ এসব চিত্র তুলে ধরে পোস্ট দিচ্ছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিশেষত দেশের শিক্ষা কারিকুলাম থেকে নজরুলের কবিতাসহ সাহিত্যকর্মগুলো বাদ দিয়ে বিজাতীয় ও হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির পাঠ্যক্রম বৃদ্ধির আয়োজনের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছে। জাতীয় কবির জন্মদিনের আয়োজনে অংশ নিতে আসা নজরুলের উত্তরসূরী (নাতনী)রাও বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম থেকে নজরুলের অধিকাংশ লেখা বর্তমান সরকার বাদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন। শুধু নজরুলের রচনাই নয়, ইসলামী মূল্যবোধ সম্পৃক্ত অধিকাংশ কবিতা, গল্প-রচনাই পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইসলাম বিরোধী পাঠ্যক্রম ও প্রস্তাবিত বিতর্কিত শিক্ষা আইন বাতিলের দাবীতে দেশের আলেম সমাজ এবং কোন কোন ইসলামিক রাজনৈতিক দল কিছু প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করলেও দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি-জামায়াতের নীরবতা বিস্ময়কর। এমনকি জাতীয় কবি’র ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাদের আয়োজনও ছিল অনেকটা দায়সারা গোছের। তারা দেশের মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে এখন শাসকদলের জুলুম, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অথচ নজরুলের সাহিত্য, শিক্ষা ও চেতনাকে জাতির সামনে সাড়ম্বরে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সকল অন্যায়-অবিচার ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। চিরতরে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আগে ১৯৪০ সালে এক সাক্ষাৎকারে কবি নজরুল বলেছিলেন, “মুসলমানরা যে একদিন দুনিয়াজোড়া বাদশাহী করতে সমর্থ হয়েছিল সে তাদের ঈমানের বলে। আজ আমরা ঈমান হারিয়ে ফেলেছি। ঈমানের অর্থ ‘পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ’। ভারতে রাজা-বাদশাহদের দ্বারা ইসলাম জারি হয় নাই।” দেশের সরকার যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে জাতির উপর সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চাইছে। তারই প্রেক্ষাপটে জাতীয় কবি নজরুলের লেখা পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে, তখন এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিও নজরুলকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন, উপস্থাপন বা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের জাতীয় কবি তার কবিতা, গানে ও গদ্যে একদিকে যেমন হিন্দু-মুসলমান সম্মিলন ও সম্প্রীতির কথা বলেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি ও স্বর্ণোজ্জ্বল ঐতিহ্যের কথা বলেছেন। তাকে বাদ দিয়ে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœœ রাখা অসম্ভব। এ জন্য জাতীয় কবি নজরুলের জন্মতিথিই হবে এই জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য প্রাণের উৎসব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন