০ ছোট, মাঝারি, বড়-সব ধরণের ঋণ খেলাপিরা সুবিধা নিতে পারবে
ঋণখেলাপিরা মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ ১০ বছর মেয়াদে তারা ৯ শতাংশ সুদে এই ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবে। প্রথম একবছর কোনও কিস্তি দিতে হবে না। ছোট, মাঝারি বা বড়-সব ঋণ খেলাপিই পুন:তফসিলের সুযোগ পাবেন। ঋণ খেলাপিদের আগের অনারোপিত সব সুদ মওকুফ করে দেওয়া হবে। এদিকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী ভালো গ্রাহকদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে সনদ, প্রকাশ করা হবে তাদের ছবি। পরিশোধিত সুদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মওকুফ করা হবে। গতকাল এ সংক্রান্ত পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ওই নীতিমালা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা নীতিমালা হিসেবে জারি করছে।
খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল সুযোগের বিষয়ে দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো নিদের্শনায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাংকের ঋণ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিতভাবে পরিশোধ হচ্ছে না। যে কারণে ওই সব ঋণ বিরূপভাবে খেলাপি হয়ে পড়ায় ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর সময়ে মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে এমন ঋণগ্রহিতার অনুক‚লে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পুনঃতফসিল বা এক্সিট সুবিধা দেওয়া যাবে।
বিশেষ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন যারা : ট্রেডিং খাত (গম, খাদ্য দ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারী), জাহাজ শিল্প (শিপ ব্রেকিং ও শিপ বিল্ডিং) এবং লৌহ ও ইস্পাত শিল্প। এসব খাতে ব্যাংকগুলোর বিপুল অংকের বিনিয়োগ আছে। বিশেষায়িত ব্যাংকের অকৃষি খাতের আমদানি-রফতানিতে সম্পৃক্ত শিল্প ঋণ। অন্যান্য খাতে ব্যাংক থেকে বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত প্রকৃত ব্যবসায়ী, যাদের ঋণ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভ‚ত কারনে মন্দ মানে খেলাপি হয়েছে।
ঋণ পুনঃতফসিলের শর্ত : পুনঃতফসিল সুবিধা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণগ্রহিতার আবেদন প্রাপ্তির পর ব্যাংক থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক হিসাবকৃত স্থিতি মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ঋণ স্থিতির ন্যূনতম দুই শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট নগদে গ্রহণ করতে হবে। ইতোপূর্বে সংশ্লিষ্ট ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত কিস্তির অর্থ ডাউন পেমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সার্কুলার জারির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ঋণগ্রহিতার আবেদন করতে হবে। এ সময় অতিক্রান্ত হলে কোন আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। কেইস টু কেইস বিবেচনায় ঋণ পরিশোধের সময়কাল সর্বোচ্চ এক বছরের গ্রস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছর হবে।
ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ এবং ইন্টারেস্ট সাসপেন্স হিসাবে রক্ষিত সুদ মওকুফ করা যাবে। তবে মওকুফকৃত সুদ পৃথক বøকড হিসাবে (সুদবিহীন) স্থানান্তর করতে হবে। পুনঃতফসিলের শর্তানুযায়ি সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধের পর বøকড হিসাবে রক্ষিত সুদ চূড়ান্ত মওকুফ হিসাবে বিবেচিত হবে।
ঋণ স্থিতির (মওকুফ অবশিষ্ট) উপর কস্ট অব ফান্ডের সঙ্গে তিন শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য হবে। তবে সুদের হার নয় শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে উক্ত হারে সুদ আরোপ কার্যকর হবে। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মাসিক অথবা ত্রৈমাসিক কিস্তি নির্ধারণ করতে হবে। প্রচলিত নিয়ামানুযায়ি আনুপাতিক হারে আসল এবং সুদ বিবেচনায় নিয়ে কিস্তির পরিমান নির্ধারিত হবে।
ঋণ পরিশোধের জন্য নয়টি মাসিক কিস্তির মধ্যে ছয়টি মাসিক কিস্তি অথবা তিনটি ত্রৈমাসিক কিস্তির মধ্যে দুটি ত্রৈমাসিক কিস্তি অনাদায়ী হলে এ সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে। সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবকে মন্দ মানে খেলাপি করতে হবে। ব্যাংক থেকে পুনঃতফসিল সুবিধা প্রদানের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহক সোলেনামার মাধ্যমে চলমান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের জন্য যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরবর্তীতে কোন গ্রাহক প্রদত্ত সুবিধার কোন শর্ত ভঙ্গ করলে তার অনুকুলে প্রদত্ত সকল সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে গ্রাহকের বিরুদ্ধে স্থগিত মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পুনঃতফসিল পরবর্তীতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ প্রদান করা যাবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে তাদের প্রচলিত ঋণ নীতিমালা অনুসরণ করবে। নতুন ভাবে প্রদত্ত ঋণ যথানিয়মে পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিশেষ সার্কুলারের আওতায় প্রদত্ত সকল সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে।
ব্যাংক থেকে একসঙ্গে বের হয়ে আসার উপায় : এককালীন এক্সিট সুবিধা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণগ্রহিতার আবেদন প্রাপ্তির পর ব্যাংক কর্তৃক ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখ ভিত্তিক হিসাবকৃত স্থিতি অনুযায়ি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ঋণ স্থিতির ন্যূনতম দুই শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট নগদে গ্রহণ করতে হবে। ইতোপূর্বে সংশ্লিষ্ট ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত কিস্তির অর্থ ডাউন পেমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কেন ভিত্তিতে অনারোপি সুদের সম্পূর্ণ অংশ এবং ইন্টারেস্ট সাসপেন্স হিসাবে রক্ষিত সুদ মওকুফ করা যাবে। তবে মওকুফকৃত সুদ পৃথক ব¬কড হিসাবে (সুদবিহীন) স্থানান্তর করতে হবে। পুনঃতফসিলের শর্তানুযায়ি সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধের পর বøকড হিসাবে রক্ষিত সুদ চূড়ান্ত মওকুফ হিসাবে বিবেচিত হবে। ঋণ স্থিতির (মওকুফ অবশিষ্ট) উপর কস্ট অব ফান্ড হারে সুদ প্রযোজ্য হবে। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে উক্ত হারে সুদ কার্যকর হবে। ব্যাংক থেকে এককালীন এক্সিট সুবিধা প্রদানের তারিখ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬০ দিনের মধ্যে ঋণগ্রহিতা থেকে পরিশোধযোগ্য ঋণ পরিশোধ করতে হবে। উক্ত সময়সীমার মধ্যে সমমুদয় পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে এ সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে। সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবকে মন্দ মানে খেলাপি করতে হবে।
ব্যাংক থেকে পুনঃতফসিল সুবিধা প্রদানের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহক সোলেনামার মাধ্যমে চলমান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের জন্য যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরবর্তীতে কোন গ্রাহক প্রদত্ত সুবিধার কোন শর্ত ভঙ্গ করলে তার অনুকুলে প্রদত্ত সকল সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে গ্রাহকের বিরুদ্ধে স্থগিত মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও সার্কুলারের নির্দেশনা কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, খেলাপিঋণ এককালীন এক্সিট করতে হলে এই সার্কুলারের আওতায় ঋণগ্রহীতার আবেদন পাওয়ার তারিখ হতে ৪৫ দিনের মধ্যে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে, সেব ক্ষেত্রে নিরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এর আগে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে এমন আভাস দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ২৫ মার্চ শেরেবাংলা নগরে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের তিনি জানান, যারা ঋণ শোধ করতে না পারার ‘যৌক্তিক’ কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন, তাদের মোট ঋণের দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ওই টাকা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হবে।
এদিকে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভালো গ্রাহকদের প্রণোদনা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ওই নির্দেশনা বেশির ভাগই মানেনি। গতকাল আবারী ওই প্রণোদনা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোন গ্রাহক সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৪টি ত্রৈমাসিক কিস্তি পরিশোধ করলে তিনি ভালো গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে তিনি ভালো গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন না। বিগত এক বছর পরিশোধ করা সুদের উপর ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন ভালো গ্রাহকরা। এছাড়া ভালো গ্রাহকদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডেও ছাড় দিতে বলা হয়েছে। বার্ষিক রিপোর্টে তাদের ছবি প্রকাশ ও বার্ষিক সভায় তাদেরকে সম্মাননা সনদ দিতে বলা হয়েছে ওই প্রজ্ঞাপনে।
প্রসঙ্গত, এরআগে ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় ডাউন পেমেন্ট ও মেয়াদের শর্ত শিথিল করে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নেওয়া ১১টি ব্যবসায়ী গ্রæপকে দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। ওই সময় তারা ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠিত ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় সুদে-আসলে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন