আমরা এমন একটি সময়ে এমন একটি সমাজে আছি, যেখানে এখন নিরাপদে বসবাস দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অনাচার ব্যাভিচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নির্ভয়ে নিঃশ্বাস নেয়াও যেন কঠিন হয়ে পড়েছে।
পবিত্র রমজান মাস চলছে। মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এ মাস। পুরো একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জন্য মুসলমানগণ এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকার চেষ্টা করেন এ মাসে। শুধু দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই যে রোজা নয়, তা কোরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামী চিন্তাবিদরা বলে থাকেন। এ মাসে মানুষকে সংযমী হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কথা কাজ এবং আচরণেও হতে হবে সংযমী। বিরত থাকতে হবে সব ধরনের লোভ লালসা থেকে। নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে পাপাচার থেকে নিজেকে করতে হবে রক্ষা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, রমজান মাসেও এক শ্রেণীর মানুষের অনাচার, পাপাচার ব্যাভিচরে বিরাম নেই। পবিত্র এ মাসেও দেখা যাচ্ছে অপরাধমূলক কাজের কমতি হচ্ছে না। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চলছেই। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় ভেসে আসছে পিলে চমকানো সব দুঃসংবাদ। মানুষ যেন আর মানুষ নেই। পশুদের হিং¯্র প্রবৃত্তি যেন এক শ্রেণীর মানুষের বিবেকের জায়গা করেছে। সব দেখেশুনে প্রশ্নটি স্বভাবতই পীড়া দেয় আমরা আসলে কোথায় আছি? এটা কি মনুষ্য সমাজ, নাকি শ্বপদসংকুল কোনো অরণ্য? যেখানে মানুষ কেবলই অসহায় শিকার মানুষ নামের কতিপয় হায়েনার।
সোনাগাজীর নুসরাত ট্র্যাজেডির পর অনেকেই উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলতে চেয়েছিলেন- এটাই যেন হয় এ ধরনের শেষ ঘটনা। কিন্তু না, তা হয়নি। এখনও নিরন্তর ঘটে চলেছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। সাত দিনে ৪১ শিশুকে ধর্ষণের ঘটনার পরও কী বলতে হবে আমরা একটি সভ্য সমাজে আছি? পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ ও তৎপরবর্তী হত্যার ঘটনা। মানুষ যেন পশুতে রুপান্তরিত হয়েছে। চলন্ত বাসে নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিল- অধ্যক্ষ সিরাজ, শামীম, নূরুরা জেলে থাকলেও তাদেরই গোত্রভ‚ক্তদের কমতি নেই আমাদের এ সমাজে। ওরা ঘাপটি মেরে আছে সমাজের আনাচে কানাচে। সুযোগ পেলেইে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। জন্ম দিচ্ছে বীভৎস ঘটনার। প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক- সরকারের কঠোর অবস্থানের ঘোষণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ততোধিক কঠোর পদক্ষেপের বাগাড়ম্বর সত্তে¡ও অপরাধ বিস্তারের গতি কমছে না কেন? এ নিয়ে নানাজনের নানা অভিমত আছে। তবে, একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, রাষ্ট্র এসব অপরাধের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না, যা অপরাধীদেরকে ভীত করতে পারে। বিরত রাখতে পারে অপরাধকর্ম থেকে। না, এ কথা বলা যাবে না রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে, এটা স্বীকার করতেই হবে যে, তা সংঘটিত ঘটনার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এরপর রয়েছে ‘আইনের ফাঁক’ বলে ফাঁকি দেয়ার একটি সরল পথ। ওই পথে কত শত অপরাধী প্রতিনিয়ত পার পেয়ে যাচ্ছে তার হিসাব কে রাখে? আর এই পার পাবার বিষয়টিই নতুন করে অপরাধ সংঘটনে অন্যদেরকে উৎসাহিত করে।
নুসরাত হত্যার মদতদাতাদের অন্যতম সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেমের গায়ে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো আঁচড় লাগেনি। সরকার বলেছে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ খবর হলো, তাকে রংপুর পুলিশে সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে আবার দাবিও করা হয়েছে ওই সংযুক্তিও নাকি এক ধরনের শাস্তি! নুসরাত হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন কি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা পর্যন্ত ছাড় পাননি। তারাও কারান্তরালে রয়েছেন। ওসি মোয়জ্জেম নুসরাত হত্যায় মদতদানকারীদের অন্যতম। তার অপরাধের অনেক তথ্যপ্রমাণ এখন প্রকাশ্যে। তাকে যদি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়ে থাকে, তাহলে এখন তার পরিচয় হওয়ার কথা শুধুই একজন অপরাধীর। সে অপরাধীকে গ্রেফতার না করে রংপুর পুলিশে সংযুক্ত করার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী? তবে কি সেটাই সত্যি যে, তাকে রক্ষার জন্য পুলিশ প্রশাসনের একটি অংশ নানাভাবে চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে? এই সংযুক্তি কি সে চেষ্টারই অংশ? অনেকের সন্দেহ- শেষ পর্যন্ত ওসি মোয়জ্জেম অধরা থেকে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারো কারো মতে আমাদের দেশে নাকি সবই সম্ভব। তো সব সম্ভবের সে দেশে ওসি মোয়াজ্জেমের ধোয়া তুলসীপাতা হওয়া খুব বিচিত্র কী!
রোজা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলম। প্রসঙ্গক্রমে অনেক কথাই এসে গেছে। আবার একটু রমজান পরিস্থিতির দিকে চোখ ফেরানো যাক। রোজা এলে সব জিনিসের দাম বাড়ে- এটা আমাদের দেশের সাংবাৎসরিক ঘটনা। এ নিয়ে হৈ চৈ হয় সবসময়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়, মন্ত্রীদের কঠোর উচ্চারণ শোনা যায়- ‘রমাজানে পণ্যমূল্য এক পয়সাও বাড়াতে দেওয়া হবে না’, টিভিতে আলোচকরা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। কিন্তু সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলে। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর আন্যান্য মুসলিম দেশে রমজান মাসে রোজাদারদের সুবিধার্থে পণ্যমূল্য কমানো হয়ে থাকে। আর আামাদের দেশে বাড়ানো হয়। সরকার বলছে তারা দব্যমূল নিয়ন্ত্রণে রাখতে যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তব প্রতিফলন কি দেখা যাচ্ছে? বাজার মনিটরিং সেল নামে নাকি একটি সংস্থা বেশ সক্রিয়। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি তো বলে না তাদের সে সক্রিয়তার কথা। বরং তাদের নিষ্ক্রিয়তাই যে অসাধু ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া করে তুলেছে তা অস্বীকার করার উপায় আছে কি?
রমজান মাসকে সামনে রেখে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে। গত ১০ মে পত্রিকাটি ‘খেজুর নিয়ে খেলছে যারা’ শীর্ষক এক বিশেষ প্রতিবেদেনে লিখেছে- রোজাকে সামনে রেখে গত ছয় মাসে দেশে খেজুর আমদানি হয়েছে ৩৫ হাজার ৪০৯ টন। যার মূল্য প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা। দেশের ৮০ জন ব্যবসায়ী এসব খেজুর আমদানি করেন। শুল্ক দেয়ার পর প্রতি কেজি খেজুরের দাম পড়ে ৬৭ টাকা। আর বাজারে তা বিক্রি হয় দেড় শ’ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত কেজি দরে। খেজুর আমদানিকারকদের সিÐিকেট এর বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ রিপোর্টটি প্রকাশের পর বেশ কয়েকদিন চলে গেছে। কিন্তু ওই সিÐিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো সংস্থা কোনো রকম পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন খবর পাওয়া যায়নি।
উদ্বেগের খবর আরো আছে। সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রতি তারা দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ১৯০টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছে এর মাধ্যে ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। বিশেষ করে কাঁচা তরল দুধের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯৩টিতেই ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। ওইসব উপাদান মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সংস্থাটি তাদের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন গত ৮ মে দাখিল করেছে হাইকোর্টে। এর একদিন পর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ খাদ্যপণ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইয়ের ব্যর্থতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, “যেসব নামকরা প্রতিষ্ঠান পণ্য রফতানি করে, আমরা যাদের নিয়ে প্রাউড ফিল করি, তারাও আমাদের ভেজাল খাওয়ায়। এ কী অবস্থা! আমরা কোথায় আছি? যেসব পণ্যের তালিকা দেখছি তা তো ঘরে ঘরে মানুষ সচরাচর ব্যবহার করছে। কোনো কোম্পানিই তো বাদ নেই”। নি¤œমানের খাদ্য উৎপাদন বন্ধ ও উৎপাদিত পণ্য জব্দ করার নিদের্শনা চেয়ে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব-এর করা এর রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেছেন। একই দিনে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। কথা উঠেছে পানি নিয়েও। ওয়াসার এমডি তার সংস্থার সরবরাহ করা পানির প্রতিটি ফোঁটা সুপেয় বলার পর তা নিয়ে যে তুলকালাম কাÐ হয়ে গেল তা সবারই জানা। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তাদের পানিকে বিশুদ্ধ বললেও গত ৯ মে একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় এখন সুপেয় পানি মিলছে না। সরবরাহকৃত পানিতে নানা ধরনের জীবানু ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায়। এসব উপাদান এক ধরনের বিষ। যা মানুষের শরীরে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি করে থাকে। বলা হয়ে থাকে- পানির অপর নাম জীবন। যে কোনো প্রাণীর জীবন ধারনের জন্য পানি ও বায়ূ অপরিহার্য। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দুইটি উপাদানই আর বিশুদ্ধ নেই। ভেজাল পণ্যে বাজার ছেয়ে গেছে। সর্বত্র কার্বাইড আর ফরমালিনের দাপট। সরকারের সংস্থাগুলো নাকি এসবের বিরুদ্ধে সদা তৎপর। পত্র-পত্রিকায় মাঝে মধ্যে তেমন খবরও আসে। কিন্তু তারপরও এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের দেরাত্ম্য কমার লক্ষণ নেই।
প্রশ্নটি সত্যিই কঠিন। আমরা আসলে কোথায় আছি? এটা কি কোনো সভ্য সমাজ? মানুষ কী এ ধরনের পরিবেশে বসবাস করতে পারে? এখানে নীতিকথা, ধর্মের বাণী যেন উলুবনে মুক্তো ছড়ানো। তস্কর কখনোই ধর্মের কাহিনি শোনে না সেটা সবাই জানেন। সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের কাজকর্ম যেন তারই বাস্তব রূপ। কেউ কোনো কথা শুনতে চায় না। যে যার মতো চলতে চায়, বলতে চায়, করতে চায়। আইন! সে তো কিতাবের বিষয়। আইন তো আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ কোথায়? আইনের যদি যথাযথ প্রয়োগই থাকতো তাহেলে দুষ্কৃতকারীদের কার ঘাড়ে কয়টি মাথা যে তা অমান্য করে? এখানে অনেকেরই ধারণা হয়ে গেছে- আইন তার নিজস্ব পথে চলবে, আর অপরাধীরাও তাদের নিজেদের কায়দা মতো বাঁচার পথ করে নেবে। আর সেজন্যই চোর, ডাকাত, ধর্ষক, চোরাকারবারি, অতিমুনাফালোভী, ভেজালকারী, পচাখাদ্য বিক্রেতাসহ তাবৎ দুষ্কৃতকারীরা বুকভরা সাহস নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অপরাধকর্ম। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমরা কি শুধু নুসরাত-তানিয়াদের লাশ বহন করেই যাব? অসহায় শিকার হয়ে থাকব ভেজাল আর মানহীন খাদ্য বিক্রেতাদের? আর কত গুনতে হবে লাশের সংখ্যা, আর কত শুনতে হবে খাদ্য-পানীয়তে বিষের কথা? এর শেষ কোথায়? দুর্ভাগ্য, প্রশ্ন আছে উত্তর নেই। আসলে উত্তর দেবার মতো কেউ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন