সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার গ্রেফতার করতে পারে, এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার বা অন্তরীণ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিএনপিকে নিঃশেষ করার গভীর যড়যন্ত্র করা হচ্ছে, যাতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৫টি মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। কীভাবে তাকে অন্তরীণ করা যায় সেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ বিএনপি’র মহাসচিব ও সিনিয়র নেতাদের এসব বক্তব্য-বিবৃতির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই নেতা এবং মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও ওবায়দুল কাদের গতকাল স্পষ্ট করে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, আমরা কেন বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করতে যাব? কাউকে গ্রেফতার করার ইচ্ছা আমাদের নেই। আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে যতদূর জানি, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারে সরকারের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের আশঙ্কা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব ও সিনিয়র নেতারা যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন, সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর এ বক্তব্যের কারণে নিঃসন্দেহে দলটির মধ্যে যেমন স্বস্তি ফিরে আসবে, তেমনি বিএনপি’র বিপুলসংখ্যক সমর্থক এবং দেশের মানুষও আশ্বস্ত হবে। রাজনীতিকে নতুন করে উত্তপ্ত ও বিক্ষুব্ধ করে তোলার এ ধরনের কোনো পদক্ষেপের আশঙ্কা দূর করার জন্য সরকারের তরফ থেকে একটি স্পষ্ট বক্তব্যের প্রয়োজন ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য দেয়াকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
বেগম খালেদা জিয়া তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং দুইবার সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন। সংসদে এখন না থাকলেও দেশের অন্যতম বৃহৎ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের একাধিক মামলার কথা সকলেই জানেন। এর মধ্যে দুটি মামলার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসব মামলার সূত্র ধরেই সরকার তাকে গ্রেফতার বা অন্তরীণ করতে পারে বলে দলটির বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীর মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার যদি এমন পদক্ষেপ নেয়, তবে দলটির নেতা-কর্মীরা তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তারা আন্দোলন-সংগ্রামে নেমে পড়বে। এতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। বলাবাহুল্য, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র মতো প্রধান দু’টি দলের শীর্ষ নেত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা বা গ্রেফতারের মতো ঘটনা দল দু’টির নেতা-কর্মীরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। অতীতের ঘটনা থেকে দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। যতবার তারা গ্রেফতার হয়েছেন, তা নেতা-কর্মীদের কাছে প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে গণ্য হয়েছে। এ নিয়ে তারা ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন করেছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এখন বিএনপি চেয়ারপার্সনকে যদি গ্রেফতার করা হয়, তবে দলটির নেতা-কর্মীদের একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো স্বাভাবিক। এতে আপাত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুনরায় সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাহ্যিকভাবে স্থিতিশীল মনে হলেও, সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো অন্তর্গতভাবে যে অস্থিতিশীল ও অনিশ্চয়তায় পূর্ণ, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাত্রই জানেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের দিকে যদি দৃষ্টি দেয়া যায় তবে দেখা যাবে সেখানে বিনিয়োগের করুণচিত্র। বিনিয়োগ বৃদ্ধি দূরে থাক স্বাভাবিক বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ তলানীতে ঠেকেছে। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসেবেই নতুন কর্মসংস্থান আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে কর্মচ্যুত লাখ লাখ বেকার। বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় দেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। এরই মধ্যে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের লুটতরাজের অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিদেশে তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছে এবং সেখানে কারখানা গড়ে তুলছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক কর্ম-চাঞ্চল্য নেই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। তাদের বিক্রি-বাট্টা কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে। অনেকে ব্যবসা বৃদ্ধির চিন্তা দূরে থাক, বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। সাধারণ মানুষও অর্থকষ্টে কোনো রকমে দিন গুজরান করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও অর্থনীতির এ দুরবস্থা কাটাতে পারছে না। এর মূল কারণ যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আস্থার সংকট, তা বোধকরি ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। প্রত্যেকের মধ্যে এ শঙ্কা কাজ করছে যে, আপাত দৃষ্টিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দৃশ্যমান হলেও, তা যে কোনো সময় অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতির সাথে যুক্তরা এটাও জানেন, বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে দমিয়ে রাখলেও, যে কোনো সময় তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এতে পরিস্থিতি তপ্ত হয়ে উঠবে। স্থিতিশীলতা পুরোপুরি বিনষ্ট হবে। এরকম অনিশ্চিত ও আস্থাহীন পরিস্থিতির মধ্যে যদি বিএনপি চেয়ারপার্সনকে গ্রেফতারের মতো কোনো ঘটনা ঘটে, তবে তা আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়ে দাঁড়াবে। সরকারও যে এটা বোঝে না, তা নয়। বোঝে বলেই দু’মন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলেছেন, বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করার চিন্তা-ভাবনা সরকার করছে না।
দেশে সরকার ও বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও পারস্পরিক সহাবস্থান থাকুক, এটা সকল নাগরিকেরই কাম্য। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেক বলেছেন এবং এখনও বলছেন। বস্তুত, দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা উভয়পক্ষেরই দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত হলে সরকারের পক্ষে সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। দেশের মানুষ এখন এ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে। সর্বত্রই এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আস্থার সংকট বিরাজমান। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। তা না করে যদি সরকার তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়, তবে তা কোনোভাবেই শুভবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না। এতে সরকারের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ হবে না। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে উত্তাল হোক, এমন কোনো পদক্ষেপ সরকার নেবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন