বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিদেশী ফান্ড ব্যবহারে ব্যর্থতার কারণ রাজনৈতিক

প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জাপান বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ৬শ’ কোটি ডলারের অংশ বিশেষ দেড়শ’ কোটি ডলার প্রদান করার আশ্বাস দিয়েছে। জাপানের নাগোয়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে এ আশ্বাস প্রদান করে বলেছেন: ‘আমাদের সরকার বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ৬শ’ কোটি ডলার সহযোগিতা প্রদানের অংশ হিসেবে এবছর দেড়শ’ কোটি ডলার প্রদান করবে।’ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বৈঠকের পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আরো জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে পদ্মাপাড়ের চরজানাবাতে একটি অত্যাধ্যুনিক বিমানবন্দর তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন। এছাড়া জাপান ২০১৯ সালের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করে দেয়ার ব্যাপারেও নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। জাপানের এই আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি বড় সুখবর। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপান বরাবরই বাংলাদেশের ব্যাপারে অত্যন্ত নমনীয়। বাংলাদেশের উন্নয়নে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা অস্বীকার করা যাবে না, উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার প্রতিশ্রুত সহায়তা অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে ছাড় হয় না। ছাড় হলেও সময়মত তাদের শর্ত অনুযায়ী ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। একারণে সহায়তার অংশ বিশেষ ফেরত পর্যন্ত চলে যায়। সাম্প্রতিক কালে সহায়তা ফেরত যাওয়ার বেশ কিছু ঘটনার কথা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ১০টি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা ফেরত চেয়েছে।
অন্য এক খবরে জানা গেছে, অব্যবহৃত বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ গত মার্চ নাগাদ ২২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বল্প সুদের এই বিশাল অংকের অর্থ পাইপ লাইনে পড়ে আছে। সহায়তা ব্যবহারে ধীরগতিই এর কারণ। অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাড়লেও সেই তুলনায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সহায়তা ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়েনি। চলতি অর্থ বছরে ৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও ছাড় হয়েছে ২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। ইআরডি’র একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলতি অর্থ বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা ব্যবহার করা সম্ভব হলে সেটা হতো সন্তোষজনক। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। অথচ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার জন্যই এটা হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ২০১১-১২ অর্থ বছরে তা ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। অথচ ২০১১ সাল পর্যন্ত অর্থ ছাড়ের পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের নীচে ছিল। পরবর্তী বছরে বাড়তে শুরু করে এবং গত দু’বছরে তা ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। একে কোনো বিবেচনাতেই সন্তোষজনক লেভেল বলা যায় না। এটা খুবই বিস্ময়কর যে, সরকারের তরফে উন্নয়নের গাল-গল্প ও বিশাল বিশাল ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছে। অথচ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন সহায়তা ব্যবহার করার সক্ষমতা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর নেই। পাইপ লাইনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ পড়ে আছে; তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সক্ষমতার অভাবে। একে শুধু মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অক্ষমতা ও ব্যর্থতা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটা সরকারের একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তাদের মতে, প্রশাসন নির্বিচার দলীয়করণের শিকার হওয়ায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অদক্ষ-অযোগ্য ব্যক্তিরা মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রকল্পগুলোর শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তাদের পক্ষে উন্নয়ন কর্মকা- সঠিকভাবে ও সুচারুরূপে সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি।
পাইপ লাইনে পড়ে থাকা বিনিয়োগযোগ্য, ব্যবহারযোগ্য বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক সহায়তার অর্থ যথাসময়ে ছাড় ও ব্যবহার করা সম্ভব হলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যরকম চিত্র আমরা এখন প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। এও লক্ষণীয়, বৈদেশিক সহায়তা যেমন অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, তেমনি বিপুল জনশক্তিকেও সরকার ব্যবহার করতে পারছে না। জনশক্তি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এ সম্পদ অব্যবহৃত ও অবহেলিত রয়েছে। দেশে বিনিয়োগ নেই, শিল্পায়ন নেই। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। যুবশক্তি বেকার হয়ে আছে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনশক্তি এত অধিক, যা অনেক দেশেই নেই। এই জনশক্তিকে উৎপাদন, উন্নয়ন ও সৃজনকর্মে সংযুক্ত করতে পারলে বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত হতে পারে। বৈদেশিক সহায়তা, বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং জনশক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারার পেছনে সরকারের ভ্রান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই মূলত দায়ী। এখনই যদি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া না যায়, সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ উন্নয়ন-সমৃদ্ধির যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তা স্বপ্নই হয়ে থাকবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন