মহান নেয়ামতপূর্ণ বরকতময় মাস পবিত্র রমজান। এ মাস পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। আর কোরআন নাজিলের মহান দিন পবিত্র লায়লাতুল কদর। পবিত্র রমজান, পবিত্র কোরআন, পবিত্র লায়লাতুল কদর। যা আমাদের জন্য আল্লাহতালা প্রদত্ত মহান নেয়ামত। বিশেষ করে লায়লাতুল কদর এমনি একটি রজনী যে রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী। এ রাতের ফজিলত বর্ণনায় সূরা আল কদর নামের একটি সূরাও নাজিল হয়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) বছরের যে পাঁচটি রাতের বিশেষ গুরত্ব বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে শবে কদর বরকতময় অন্যতম একটি রজনী।
একদা হযরত মোহাম্মদ (দ.) সাহাবায়ে ক্বেরামদের নিকট বনী ইসরাইলের একজন অলি আল্লাহ হযরত শামউন (রা.) এর গুণকীর্তন করছেন। তিনি বলেন, হযরত শামউন হাজার মাস এভাবে ইবাদত করেছেন যে, তিনি রাতের বেলায় ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং দিনের বেলায় রোজা রাখতেন। তিনি আল্লাহর পথে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতেন। তিনি এত শক্তিশালী ছিলেন যে, লোহার কপাট, মজবুত শিকল নিজ হাতে ছিড়তে পারতেন। দুষ্ট কাফের দল যখন দেখল যে, হযরত শামউন (রা.)কে কোনো অস্ত্র দ্বারা ঘায়েল করা যাচ্ছে না। তারা তখন অনেক ধন সম্পদ দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে রাজী করাল যেন তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় শক্ত শিকল দিয়ে বেঁধে তাদের কাছে সোপর্দ করে। অকৃতজ্ঞ স্ত্রী এ রকম করল। যখন তিনি জাগ্রত হলেন দেখতে পেলেন যে তাঁর সমস্থ শরীর শক্ত শিকল দিয়ে বাঁধা। তিনি আল্লাহর নামে নড়াচড়া করতেই সব শিকল ছিঁড়ে যায়। তার স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন কে তাঁকে শিকল দিয়ে বেঁধেছেন। স্ত্রী বলল আমি এ দ্বারা আপনার শক্তি পরীক্ষা করছিলাম। হযরত শামউন (রা.) বললেন, আল্লাহর বিশেষ রহমত আমার উপর রয়েছে। কেউ আমাকে এভাবে বাঁধলেও আমার কিছু হবে না। তবে আমার মাথার চুল দ্বারা আমাকে বাঁধলে তা ছিড়তে পারব না। লোভী প্রতারক স্ত্রী সুযোগ খুঁজে একদিন চুল দিয়ে হযরত শামউন (রা.)-কে বেঁধে কাফেরদের হাতে তুলে দেয়। তারা চরমভাবে তাঁকে শহীদ করে। সাহাবায়ে ক্বেরামগণ এ কাহিনী শুনে রাসুলে করীম (দ.) এর নিকট আরজ করলেন, এয়া রাসুলুল্লাহ (দ.) তিনি অনেক হায়াত পেয়েছেন বিধায় দীর্ঘ সময় আল্লাহর ইবাদত করা সুযোগ পেয়েছেন। আমারা তো তত হায়াত পাই না। কাল কেয়ামত দিবসে ইবাদতের কারণে তিনি আমাদের চেয়ে মর্যদাবান হবেন। সাহাবায়ে ক্বেরামগণের এ কথা শুনে রাসুলে করীম (দ.) বিষন্ন হলেন। সাথে সাথে আল্লাহতালা তাঁর হাবীবের নিকট জিব্রাইল (আ.) কে পাঠিয়ে সুসংবাদ দিলেন যে, আপনার উম্মতদের দীর্ঘ হায়াত না দিলেও তাদেরকে এমন এক রাত দিয়েছি যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। তারা এক রাত ইবাদত করলে হযরত শামউন (রা.) এর চেয়ে বেশি সওয়াবের মালিক হবে। আল হামদুলিল্লাহ।
অন্য এক বর্ণনায়, রাসুলে পাক (দ.) সাহাবায়ে ক্বেরামের নিকট একদিন বনী ইসরাইলের চার জন মহান ব্যক্তি সম্পর্কে আলোকপাত করেন যে, তাঁরা আশি বছর ধরে আল্লাহতালার ইবাদতে লিপ্ত ছিলেন। ক্ষণিকের জন্যও তারা কোনরূপ আল্লাহতালার নাফরমানী করেননি। দীর্ঘ সময় তাঁদের ইবাদত-বন্দেগী ছিল ত্রুটিমুক্ত। পুনরায় চারজন সম্মানিত নবীর নাম উল্লেখ করেন, হযরত আইউব (আ.) হযরত যাকারীয়া (আ.) হযরত খরকীল (আ.) হযরত ইউশা বিন নূন (আ.)। তা শুনে সাহাবাগণ (রা.) আশ্চর্য হলেন।
ঠিক তখনি হযরত জিব্রাইল (আ.) উপস্থিত হয়ে বলেন যে, আল্লাহতালা তদপেক্ষা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ রজনী দান করেছেন আর তা হলো শবে কদরের রাত্রি। এ বলে হযরত জিব্রাইল (আ.) সূরা আল কদর সম্পূর্ণ রাসুল (দ.) কে পাঠ করে শোনালেন। এতে রাসুল (দ.) আনন্দিত হলেন।
আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায়, হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুলে করিম (দ.)-কে প্রশ্ন করলাম হে আল্লাহর রাসুল এখন তো আল্লাহতালা জিব্রাইল মারফত আমাদেরকে সালাম দিচ্ছেন। আপনার ইন্তেকালের পর কী হবে। দয়াল আল্লাহ তখন এ সূরা নাজিল ঘোষণা দিলেন যে আমার প্রিয় নবী দুনিয়াতে না থাকলেও কিয়ামত পর্যন্ত জিব্রাইল (আ.) প্রত্যেক লায়লাতুল কদর রাতে ফেরেশতা বাহিনী নিয়ে তাঁর উম্মতদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সালামের বাণী নিয়ে আসবেন। এ প্রসঙ্গে সূরা আল কদর নাজিল হয়।
আল্লাহতালা হযরত জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে হযরত মোহাম্মদ (দ.) এর নিকট এমন সুসংবাদ প্রেরণ করেন যে (সূরা আল কদর) নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন কদরের রাত কী? কদরের রাত হচ্ছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেস্তাগণ ও রুহ (হযরত জিব্রাইল বা বিশেষ ফেরেস্তা) প্রত্যেক কাজে তাদের প্রভূর অনুমতিক্রমে অবর্তীণ হয়। (সে আদর্শবার্তা হচ্ছে চিরন্তন) প্রশান্তি তা, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
সূরা দু খানেও লায়লাতুল কদর সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আমি কোরআনকে একটি গুরত্বপূর্ণ রাতে অবর্তীণ করেছি আর অবশ্যই আমি হচ্ছি সতর্ককারী।
এ রাতে প্রত্যেক গুরত্বপূর্ণ কাজের ফয়সালা করা হয়।
হযরত উবাদাহ বিন সামিত হযরত মুহামম্মদ (দ.)-কে লায়লাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, রাসুলে করীম (দ.) বলেন, তোমরা লায়লাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশ দিনের মধ্যে বিজোড় তারিখের রাতে তথা ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ তারিখ রাতে তালাশ কর। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় লায়লাতুল কদরকে তালাশ করে উদযাপন করল তার যেন পূর্বাপর সকল গোনাহ ক্ষমা হবার তাওফিক হলো।
রাসুলুল্লাহ (দ.) আরো বলেন, লায়লাতুল কদরের নির্দিষ্ট তারিখ আমাকে জানানো হয়েছে। তারপর আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তোমরা লায়লাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশ বিজোড় রাতে তালাশ কর। আর আমি নিজেকে মাটি ও পানির মধ্যে সিজদা দিতে দেখেছি।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ দশকে ইশার নামায জামাতের মাধ্যমে আদায় করবে সে লায়লাতুল
কদর পাবে।
হযরত ওয়াসিলা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ইহা একটি মৃদু আলোকসজ্জল রাত, যাতে না আছে গরম, না আছে ঠান্ডা, না আছে মেঘ, না আছে বৃষ্টি, না আছে প্রবল বাতাস আর না কোনো তারা এ রাতে নিক্ষেপিত হবে। দিনের আলামত হচ্ছে পরের দিনে সূর্য উদিত হবে কিরণহীন অবস্থায়।
হযরত উবদা ইবনে সাবেত (রা.) বর্ণনা করেন আমি রাসুলেপাক (দ.)-কে লায়লাতুল কদর সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এ রাতের আলামতের মধ্যে এটিও জেনে নাও যে, এ রাত উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ হয়ে থাকে। এ রাতে না বেশি গরম না বেশি ঠান্ডা পড়ে। পরদিন সকাল বেলায় সূর্যের তাপ থাকে খুব ক্ষীণ।
হযরত উবাদাহ ইবনে ইমরান (রা.) বর্ণনা করেন, আমি বুহাইরায়ে কুরযুমের কিনারায় ছিলাম। আমি যখন সমুদ্রের পানি দ্বারা ওজু করতে পানি মুখে নিলাম তখন বুঝতে পারলাম পানি অন্য দিনের ন্যায় লবণাক্ত নয়। বরং এটি মধুর ন্যায় মিষ্টি। আমি আশ্চর্য হয়ে এ ঘটনা হযরত ওসমান (রা.)-কে বললাম, তিনি বললেন, সে রাতটি লায়লাতুল কদর ছিল।
এ রাত এমনি মহামান্বিত রাত, এ রাতে স্বয়ং হযরত জিব্রাঈল (আ.) অগণিত ফেরেস্তা নিয়ে আকাশ হতে এ ধরাধামে নেমে আসেন। ঐ সকল ফেরেস্তা সিদরাতুল মুনতাহাতে অবস্থান করেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন এদের সংখ্যা সত্তর হাজার। তারা নূরের পতকা নিয়ে আসেন। ঐ পতকা পৃথিবীর চারস্থানে পুঁতে দেন। ১. কাবা শরীফ ২. রাসুলে পাক (দ.) এর রওজা শরীফের উপর ৩. বায়তুল মুকাদ্দাসের উপর ৪. তুর সিনা মরজিদের পাশে।
অতঃপর হযরত জিব্রাইল (আ.) সকল ফেরেস্তার উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়। যেখানে মুমিন বান্দার উপস্থিতি থাকে। সকল ইবাদতকারী মুমিন নরনারীর ঘরবাড়িতে, মসজিদ ইবাদতগাহে ফেরেস্তারা প্রবেশ করে থাকেন। যারা এ ভাগ্য রজনীতে জাগ্রত থেকে নামাজ কালাম, জিকির আজগার, মিলাদ ক্বেয়াম, কোরআন তেলেওয়াত, দোয়া মোনাজাত ইত্যাদি ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকেন তাদের সাথে সাথে ফেরেস্তারাও জিকির আজগারে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ইবাদতকারীর দোয়া মোনাজাত আল্লাহর দরবারে কবুল করার লক্ষ্যে আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন। মাঝে মাঝে ফেরেস্তারা ইবাদতকারীর দোয়া মোনাজাতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের হাতের সাথে হাত মিলিয়ে মুসাফিহা করে থাকেন। তাতে ইবাদতকারীর নম্র বিনয়ী হৃদয় এক অজ্ঞাত অনূভূতিতে কাঁদতে থাকে। অনেকে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। সমস্ত পাপের কথা স্মরণ করে খুবই বিনয়ীভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এমতাবস্থায় ইবাদত কারীর পক্ষে ফেরেস্তারাও আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন বিধায় আল্লাহর অফুরন্ত দয়া ইবাদতকারীর উপর বর্ষিত হয়। পবিত্র কদর রজনী সমাপ্তে ফেরেস্তারা যখন ফিরে যায় তথাকার ফেরেস্তারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করে পূর্ব রাতে কোথায় ছিলে। তাতে তারা জবাবে বলেন, আমরা উম্মতে মোহাম্মাদীর পাপমার্জনা ও তাদের দোয়া কবুল করানো এবং তাদের মর্যদা বৃদ্ধি করার জন্য পবিত্র শবে কদর রাতে তাদের সাথে ছিলাম। আল্লাহতালা তাদের পক্ষে আমাদের সুপারিশ কবুল করেছেন। তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে ফেরেস্তাগণ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করতে থাকেন।
এভাবে ফেরেস্তারা আরো যত ঊর্ধ্বাকাশে গমন করতে থাকেন তখন সকল ফেরেস্তারা এত মধুর আওয়াজে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকেন যে তাদের ঐ শব্দ আরশে আজীম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। স্বয়ং আরশে আজীমও আল্লাহর পবিত্রতা, শোকরীয়া ও প্রশংসা করতে থাকে। এক পর্যায়ে আল্লাহপাক আরশকে তার আনন্দের কথা জিজ্ঞেস করলে আরশে আজীম জবাবে বলে, হে আল্লাহ আমাদের কাছে সংবাদ এসেছে যে আপনি গত রাতে লাইলাতুল কদরে হযরত মোহাম্মদ (দ.) এর প্রিয় উম্মতদের গোনাহ ক্ষমা করেছেন। তাদের মাঝে বদকার লোকদের পক্ষে নেককার লোকদের সুপারিশ কবুল করেছেন। সে কারণে আমরাও আনন্দ প্রকাশ করছি। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তখন আল্লাহপাক বলেন, ওহে আমার আরশ তুমি সত্য বলছ, আমার প্রিয় হাবীবের উম্মতদের জন্য আমার এখানে এতো মহাপরিমাণ মর্যদা ও শেষ্ঠত্ব রয়েছে যে, এ ধরনের কেউ কোনো চক্ষুদ্বারা দেখেনি, না কেউ কান দ্বারা শ্রবণ করেছে, না কোনো কেউ কোনো হৃদয় দ্বারা ধারণ করতে পেরেছে। আলহামদুলিল্লাহ্।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদর উদযাপন করল, তার অতীতের সকল গোনাহ যেন ক্ষমা হয়ে গেল।
হযরত মাসরুক (রহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, যখন রমজান মাসের শেষ দশক প্রবেশ করত তখন হযরত মুহাম্মদ (দ.) পুরো রাত জাগ্রত থাকতেন এবং তার পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে রাখতেন। আর তিনি কোমর বেঁধে ইবাদত করতেন।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। আমি বললাম হে আল্লাহ রাসুল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোনো রাত শবে কদর তাহলে কোন দোয়া পড়ব। তিনি ইরশাদ করেন তুমি এ দোয়া পড়, হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালবাস। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার, বাংলাদেশ টেলিভিশন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন