শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আইনের শাসন ও বিনিয়োগ বাস্তবতা

প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, দেশে যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে বিদেশের কোন বিনিয়োগ এখানে আসবে না। তিনি আরো বলেছেন, বিদেশ থেকে যে এখানে আসবে বিনিয়োগ করতে সে প্রথমে দেখবে এদেশে আইনের শাসন কী রকম, এ দেশে আমি যে টাকা বিনিয়োগ করব, তা তুলে নেয়ার নিশ্চয়তা আছে কিনা। এ দেশে যে মামলাগুলো আছে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে কিনা, কারণ আমি যদি মামলায় পড়ে যাই আমার টাকাটা দীর্ঘদিনের জন্য আটকে যাবে কিনা। এদিকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইনে স্থায়ীভাবে প্যাকেজ মূসক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গতকাল সোমবার মানববন্ধন করেছেন ব্যবসায়ীরা। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এ কর্মসূচী পালন করেছেন। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিনিয়োগ স্থবির, বাড়ছে ব্যবসার খরচ। এদিকে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি তথ্য বলছে, সাত বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের হার সাড়ে ২১ থেকে ২২ শতাংশে সীমিত হয়ে পড়েছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক মনে করেন,ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বা ব্যবসা করেন মুনাফার আশায়। তাই বিনিয়োগের আগে তারা ভবিষ্যতের অর্থনীতির গতিশীলতা, ব্যবসার খরচ ও তার বিপরীতে সম্ভাব্য মুনাফাÑ এসব বিষয়কে বিবেচনায় নেন। অর্থনীতিতে গতিশীলতা থাকবে কিনা এটা ব্যবসায়ীরা বিশ্বাস করতে পারছে না বলেই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কার্যত দেশীয় ব্যবসায়ীরা যেখানে বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না, সেখানে বিদেশি বিনোয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টি এখন একটু দূরের ভাবনা বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রধানত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সব মহলই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক সবাই এ কথা বারবার বলে আসছে যে, বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত জিডিপি অর্জন করতে হলে দেশে আস্থার বাতাবরণ তৈরি করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে যাই বলা হোক না কেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিই যে সংকটের মূল কারণ সে ব্যাপারে কোন মহলেই বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি উত্তরণে কেউ সুপরামর্শ দিলেও সরকারের কোন কোন মহল থেকে একে বিদ্বেষমূলকই ভাবা হচ্ছে। যে কোন কারণেই হোক সরকারে দায়িত্বশীল মহলে এক ধরনের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনবিমুখিতা রয়েছে। দেশে চলমান প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং আক্রমণাত্মক নীতি দেশের মানুষকেই যেখানে আস্থাহীন করে তুলেছে সেখানে বিদেশীদের আশ্বস্ত করার উপায় কি? গুম, খুন, হত্যা এখন নিয়মিত ফিচারে পরিণত হয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করলে একথা সুনির্দিষ্ট করেই বলা যায়, রাজনীতিতে সুবাতাস না বইলে অর্থনীতির মন্দাও কাটার কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। মূসক নিয়ে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা যে দাবি জানিয়ে আসছে তা যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রেও অশনি সংকেত রয়েছে। একথা অস্বীকার করা যাবে না দেশ কার্যত চোরাচালানী অর্থনীতির খপ্পরে পড়েছে। ফলে প্রকৃত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। এটাও বারবার বলা হচ্ছে, পুঁজি কখনো বসে থাকে না। সে তার সুবিধামত জায়গায় পৌঁছে যায়। রাজনৈতিক অসন্তোষের কারণে ইতোমধ্যেই অনেক পুঁজি স্থানান্তরিত হয়েছে। একথাও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না যে প্রকৃত অর্থে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার না থাকায় শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসসহ অন্যান্য বিষয়েও নানা অব্যবস্থাপনা অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নতুন নয়। দেশের বিশিষ্ট জনেরাসহ বোদ্ধামহল অনেকদিন থেকেই এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে বলে আসছেন যাতে করে বিনিয়োগ বান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। কার্যত এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এই বাস্তবতা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। সে বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তাকে একটুও অতিশয়োক্তি বলা যাবে ন,া বরং তার বক্তব্যে সময়ের প্রতিফলন ঘটেছে।
যত কথাই বলা হোক, যত বড় বড় প্রকল্পই গ্রহণকরা হোক বা উন্নয়নের যত ধরনের বুলিই আওড়ানো হোক না কেন অর্থনীতি চাঙ্গা করা না গেলে সব কিছু মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। অর্থনীতি না বাঁচলে রাজনীতিও বাঁচবে না। অর্থনীতি চাঙ্গা না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগের সাথে সম্পর্ক রয়েছে কর্মসংস্থানের। ক্রমবর্ধমান কর্মোপযোগী তরুণদের কাজে লাগাতে না পারলে তার নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্রই পড়তে বাধ্য। এমনিতেই বাস্তব অবস্থা হচ্ছে দেশে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকার রয়েছে। ফলে এমন আশংকাও হয়ত অমূলক নয় যে, বেকারত্ব যদি বাড়তেই থাকে তাহলে তার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব আইন-শৃঙ্খলার উপরও পড়তে পারে। সবকিছু মিলে কথা এই যে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে দেশ কার্যত এখন এক ধরনের একমুখিতায় ভুগছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে সাধারণের মধ্যেও যেমনি আস্থার ভাব বৃদ্ধি পাবে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলেও এর ইতিবাচব প্রভাব পড়তে বাধ্য। একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হতে বাধ্য। এর সুফল সর্বত্রই পড়বে। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার আশু প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। এলক্ষ্যে যা যা করণীয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টমহল যতœবান হবেন বলে দেশবাসী প্রত্যাশা করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন