সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পলিথিন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে

প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ব্যাপক হারে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় সম্পর্কে এখন আর কারো দ্বিমত নেই। দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবী এবং ঢাকা শহরের চারপাশের নদ-নদী দূষণ, সামান্য বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার মত বাস্তব সংকটের প্রেক্ষাপটে সরকার অবশেষে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও আইনের বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। আমাদের নাগরিক জীবনে পলিথিন ব্যাগ যেমন একটি অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পাশাপাশি পলিথিন ব্যাগের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশগত প্রতিক্রিয়া আমাদের নগরব্যবস্থাকে একটি অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আশির দশক থেকেই দেশের পরিবেশবাদীরা অপচনশীল এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সৃষ্টিকারী পণ্য হিসেবে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কাছে জোর দাবী জানিয়ে আসছিল। বিশেষত ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার জন্য কোটি কোটি পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগের জমাটবদ্ধতাকে দায়ী করা হয়। সেই থেকে ঢাকার পানিবদ্ধতা, নদীদূষণসহ পরিবেশগত সংকট মোকাবেলায় পলিথিন ব্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, দেশের প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলাশহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত পলিথিন ব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার পানিদূষণ, মাটিদূষণসহ নানা ধরনের পরিবেশগত হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার ২০০২ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অবৈধভাবে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানী ও বিপণনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ-, ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ-ের বিধান রেখে আইন পাস করা হয়। আর নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রদর্শন, সংরক্ষণ ও গুদামজাত করার অপরাধে ৬ মাসের কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়। কঠোর আইন প্রণয়নের সাথে সাথে সে সময়ের পরিবেশমন্ত্রী নিজেও পলিথিন বিরোধী অভিযানে মাঠে নেমেছিলেন। একই সাথে পাটের ব্যাগ বাজারজাতকরণ এবং পলিথিন শিল্পের সাথে জড়িতদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি পলিথিনের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালনার ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরে পলিথিনের ব্যবহার অনেকটা কমে এসেছিল। তবে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে এবং ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের সময় থেকে পলিথিন বিরোধী পদক্ষেপ অকার্যকর হয়ে পড়তে শুরু করে বলে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে আইন রহিত না হলেও আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন না থাকায় পলিথিন বা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আইনগুলো জনকল্যাণে কোন কাজে আসছে না। বর্তমান সরকারও পলিথিন উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের পাশাপাশি কিছু পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটজাত পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা জারি করেছে। তবে সরকারের এসব উদ্যোগের সাথে মাঠ পর্যায়ে বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ না থাকায় পলিথিনের ব্যবহার কমার বদলে আরো অনেক বেড়ে গেছে।
প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে দ-নীয় আইনের বিধান করার আগে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯৩ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হতো। কঠোর আইন এবং সরকারের পলিথিন বিরোধী অবস্থান ঘোষিত হওয়ার পর এখন দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড়কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। আশির দশকের আগ পর্যন্ত এদেশের মানুষ চটের ব্যাগ, বেত-বাঁশের ডুলা নিয়ে বাজারে যেত। এখন শহর ও গ্রাম-গঞ্জের প্রায় প্রতিটি মানুষ খালি হাতে বাজারে যায় এবং মাছ, গোশত, চাল-ডাল, চিনিসহ প্রতিটি পণ্যের সাথে এক বা একাধিক পলিথিন ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ফিরে। এসব পলিথিন একবার ব্যবহৃত হওয়ার পর ডাস্টবিনে বা খালে-বিলে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। শত বছর মাটির নিচে বা পানিতে থাকলেও পলিথিন পচেনা। এ হিসাবে মাসে গড়ে প্রায় অর্ধশত কোটি পলিথিন ব্যাগ আমাদের স্যুয়ারেজ লাইনে, ময়লার ডাম্পিং স্টেশনে, নদীতে, খালে এবং জমিতে জমা হচ্ছে। ঢাকাসহ সারাদেশের নগরীগুলোর পয়ঃব্যবস্থা, নদ-নদী, খাল-বিল ও কৃষিজমি পলিথিনের দ্বারা দূষিত, বাধাগ্রস্ত ও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। পলিথিন বিরোধী আইন যথারীতি বলবৎ আছে, সরকারের পক্ষ থেকেও যখন তখন পলিথিন নিষিদ্ধে কঠোর উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণার পাশাপাশি পাটজাত মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন পাস করার পরও ঢাকাসহ সারাদেশে পলিথিন কারখানার সংখ্যা, উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ সরকারের আইন ও ঘোষণার সাথে মাঠ পর্যায়ে আইনের বাস্তবায়ন বা নিয়ন্ত্রণে সদিচ্ছার কোন প্রতিফলন নেই বললেই চলে। পলিথিনের ব্যবহার, জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশগত বিষয়গুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে কঠোর নজরদারী ও আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদ-ে ইতিমধ্যে ঢাকা শহর তার বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। উজানে পানিপ্রত্যাহার, দখল, ভরাট ও দূষণে দেশের নদ-নদীগুলো মরে যাচ্ছে অথবা উপযোগিতা হারাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় নগর জীবনের সংকট সৃষ্টি ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য দায়ী পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের কারখানাগুলো বন্ধের পাশাপাশি প্রকাশ্যে পলিথিনের বিপণন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে পলিথিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পণ্যের সহজলভ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন