বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তৈরী পোশাকের দাম বাড়াতে হবে

প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট’-এর দ্বিতীয় সভা গত বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় তৈরী পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বিশেষ অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে ইউরোপ, আমেরিকা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র প্রতিনিধিরা যৌথ ঘোষণায় স্বীকার করেছেন। ২০১৩ সালে রানাপ্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত বড় ধরনের আন্তর্জাতিক অপপ্রচারসহ নানামুখী চাপের সম্মুখীন হয়। সে সময় এই খাতের নিরাপত্তা ও শ্রমিক স্বার্থের উন্নয়নের লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আইএলও এবং বাংলাদেশ সরকারের সমন্বয়ে গঠিত সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্টের প্রথম হাই প্রোফাইল বৈঠক গত বছর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হয়। গত বছরের সভায় তৈরী পোশাক খাতের প্রত্যাশিত উন্নয়নের লক্ষ্যে যে সব শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে তার তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে বলে স্বীকার করা হলেও ইউরোপ-আমেরিকার তৈরী পোশাক ক্রেতারা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করতে এখনো নারাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আইএলও’র পাশাপাশি কানাডার প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল এবারের সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট সভার আরেকটি অগ্রগতি। সমস্যা নিরসন এবং সাসটেইনেবিলিটি উন্নয়নে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করলেও তৈরী পোশাকের মূল্যবৃদ্ধির কোন আশ্বাস তারা দিতে পারেনি।
গত তিন দশকের বেশী সময়ে তৈরী পোশাক শিল্প বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক বাণিজ্যিক শিল্পখাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশি-বিদেশী উদ্যোক্তারা এই খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় এককোটি মানুষ তৈরী পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত। বিগত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এ খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন নতুন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তৈরী পোশাক খাতের ইউরোপ-আমেরিকান ক্রেতারা নানা অজুহাতে নতুন নতুন শর্ত চাপিয়ে দিলেও আমাদের শিল্পোদ্যোক্তা ও রফতানীকারকদের সমস্যাগুলোর প্রতি অমনোযোগিতা বা শৈথিল্য দুঃখজনক। গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানামুখী চাপে ইতিমধ্যে শত শত ক্ষুদ্র ও মাঝারি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সাথে নতুন নতুন প্রতিযোগী দেশের আবির্ভাব ঘটেছে। ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির আওতায় অ্যাপারেল রফতানীকারক কয়েকটি দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সুবিধা সম্প্রসারিত হলেও বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখে আমাদের রফতানীকারকদের বড় ধরনের চাপের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাসটেইনেবিলিটি কমú্যাক্ট কমিটির বেঁধে দেয়া শর্তও যথাযথভাবে পূরণ করতে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে শিল্পোদ্যোক্তারা।
কয়েকদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পশ্চিমা ক্রেতারা বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের দাম কমিয়ে দেয়ার বার্তা দিচ্ছে। গত বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে কিছু অনাকাক্সিক্ষত নাশকতা ও অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে কয়েকজন বিদেশী নাগরিক আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে পুঁজি করে ইউরোপ-আমেরিকার বায়ারদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে তাদের পূর্বনির্ধারিত সফর ও বৈঠক বাতিল করে দেন। এমনকি অনেক কোম্পানী ক্রয়াদেশও বাতিল করে দেয়। এভাবেই এদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের উৎপাদক ও রফতানীকারকরা যখন তখন অনাহুত-অনাকাক্সিক্ষত বিড়ম্বনায় পড়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমাদের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, অধিকার এবং নিরাপত্তা নিয়ে তাদের অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা গেলেও সামগ্রিক বাস্তবতায় আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের পুঁজি রক্ষা করতে পারবেন কিনা, তারা টিকে থাকতে পারবেন কিনা, অথবা কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাবে কিনা, এসব নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। শ্রমিকের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার পাশাপাশি লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ অক্ষুণœ রাখা এবং নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখাও সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্টের একটি বড় লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বৈঠকে ইপিজেড এবং কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুপারিশসহ ৬ দফা করণীয় বাস্তবায়নের শর্ত পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। কারখানার মালিক-শ্রমিক ও সরকারী প্রতিনিধিরা এসব শর্ত পালনে সহমত পোষণ করলেও ক্রেতাদের সস্তায় পোশাক কেনার প্রবণতা একটি বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরীবৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার শর্ত পালনে উদ্যোক্তাদের উপর কোটি কোটি টাকা বাড়তি বিনিয়োগের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলেও উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়ানোর কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পণ্যের মূল্য না বাড়ালে মালিকপক্ষ ও সরকারের পাশাপাশি সাসটেইনেবিলিটি উন্নয়নে ক্রেতাদের পক্ষ থেকেও অর্থনৈতিক সহযোগিতার দাবী উপেক্ষা করা যায় না। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, উৎপাদন ও বাণিজ্যের নানামুখী চ্যালেঞ্জে প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলেও শুধুমাত্র সস্তা শ্রমিকের সহজলভ্যতাকে পুঁজি করে তৈরী পোশাক রফতানীকারকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সক্ষম হচ্ছে। অ্যাকর্ড ও কমপ্যাক্ট শর্ত আরোপের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের মূল্য না বাড়লে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমিক, মালিকসহ এ খাতের সামগ্রিক সম্ভাবনা। কাজেই, এ বিষয়টি ক্রেতাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন