বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত প্রায় ২,৫৪৫ মাইল লম্বা। এই সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম। তবে বেশিরভাগ হত্যাই হয় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। সীমান্ত অনুপ্রবেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শ্যুট-অন-সাইট (দেখা মাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল ছিল, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া-আসা, হাটবাজার পণ্য বিক্রি করা এবং কাজ খোঁজার জন্য অনেক মানুষ নিয়মিতভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়াও সীমান্তে শূন্যরেখার কাছে কৃষিকাজ বা নদীতটে মৎস্য আহরণের জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্তপথ অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্যে কেউ বিভিন্ন ছোটখাটো এবং গুরুতর আন্তঃসীমান্ত অপরাধে নিয়োজিত। তবে উভয় দেশের সীমান্ত বাহিনী অবৈধ কার্যক্রম যেমন বিশেষ করে মাদক চোরাচালান, যৌন কাজের জন্য মানব পাচার এবং জাল মুদ্রা ও বিস্ফোরক পরিবহনে কঠোর অবস্থান নেয়। কিন্তু আঁতকে উঠা বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ এর বেশি সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগ আছে। তবে পরবর্তীতে তাদের এই অযৌক্তিক ও বিতর্কিত শ্যুট-অন-সাইট নীতি বাতিল করা হলেও বিএসএফ সন্দেহভাজনদের আক্রমণাত্মক ভীতি প্রদর্শন, নিষ্ঠুরভাবে প্রহার এবং নির্যাতন বন্ধ হয়নি।
ইতোমধ্যে বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে এমন সব অমানবিক হত্যা বন্ধে যৌথ তদন্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমন- প্রয়োজনে বিজিবি কর্মকর্তারা সরাসরি ভারতে গিয়ে তদন্ত কাজে যুক্ত হতে পারবেন। এরপর প্রকৃত ঘটনাটি উপলব্ধি করে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। শুধু তাই নয়, ২০০৮ ও ২০১১ সালে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএসএফ ও বিজিবি পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়াদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি করে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথাও বলা হয় বার বার। কিন্তু এত সব কথার প্রায়োগিক প্রতিফলন কি আমরা কাজে-কর্মে দেখেছি? এরপরেও সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যাকান্ডের চলমান এই অন্যায় ও অমানবিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে নেপাল, চীন ও পাকিস্তানের সীমান্ত থাকা সত্তে¡ও ওইসব সীমান্তে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। তাহলে স্পষ্টই ভারতের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়ায় কোথাও কোনো দুর্বলতা রয়েছে।
সত্যিকার অর্থে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী চাইলেই বা তাদের স্বদিচ্ছা থাকলেই কেবল এই সব হত্যাকান্ড ও নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করা যাবে কারণ এই চাবিকাটি একমাত্র তাদের হাতেই। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হয়তো মাঠ পর্যায়ে ঠিকমতো পৌঁছায় না বলে সীমান্ত হত্যাকান্ড এখনও বন্ধ হচ্ছে না। সর্বোচ্চ পর্যায় যদি অধিনস্থ একটি বাহিনীকে হুকুম দেয় কিংবা আদেশ বা নির্দেশ দেয় সেটি তারা মানবে না এটা ধরে নেয়া অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষেত্রে তাদের উভয়ের আন্তরিকতার প্রতিই সন্দিহান থাকা বাঞ্ছনীয়। সীমান্তে হত্যা দুই দেশের জনগণের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ককে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সীমান্ত হত্যার অন্যতম কারণ হলো গরু চোরাচালান। এই কাজে কেউ এককভাবে দায়ী নন। ভারতীয় চোরাকারবারীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে গরু এনে সীমান্ত এলাকায় জড়ো করে রাখে তারপর সুযোগ বুঝেই পাচার করে। তাই বাংলাদেশি ও ভারতীয় উভয় চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অথচ দেখা যায়, এই সব অপরাধমূলক কাজে গুলি বর্ষিত হয় শুধু বাংলাদেশিদের উপরে, যা এক তরফা ও রীতিমত অন্যায়। তাছাড়া গরুর বৈধ বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়টি নিয়ে আরও খোলামেলাভাবে আলোচনা হওয়া উচিৎ। পৃথিবীর অনেক দেশের সীমান্তেই নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংঘটিত হয়। কিন্তু সেসব জায়গায় অপরাধীদের উপর সংকটময় পরিস্থিতি ছাড়া গুলি বর্ষণের নির্দেশ থাকে না, বরং তাদেরকে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়ে থাকে। উভয় দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বার বার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে লাভের পরিবর্তে উল্টো হতাশই হয়েছে।
আমরা কেউ ভুলিনি, গা শিউরে উঠা ১৫ বছরের সেই কিশোরী ফেলানী খাতুনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। বাবার সাথেই নয়াদিল্লিতে সে গৃহকর্মীর কাজ করতো। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবের কুঠি এলাকায় ৭ জানুয়ারি ২০১১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্যরা ফেলানীকে নিজ দেশে প্রবেশের সময় গুলি করে হত্যা করে। ফেলানীর লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে হত্যাকান্ডগুলো বিশ্বঝুড়ে মানুষকে আরও একবার ব্যথিত করে। বিএসএফ ৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীর ক্যাম্পের জওয়ানদের এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। এ নিয়ে বিচারের নামে বহু নাটক হয়েছে তবে সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয় ফেলানীর পরিবার। এখনো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সহিংস সীমান্ত। ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সীমান্তও হয়তো এতো সহিংস নয়। বর্তমান সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরও চলতি বছরের এই পর্যন্ত ৬ জনের বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। প্রতিবেশী একটি দেশের মানুষকে হত্যা করার সুযোগ ভারতীয় বিএসএফ যেভাবে পেয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ দৃঢ় না হওয়ার কারণেই এটি এখনো চলছে। তাই এমনসব মৃত্যু বন্ধ করতে এখনই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে ছিটমহলসহ অনেক জটিল সমস্যার সমাধান উদাহরণ রেখেছে বর্তমান সরকার। অনুরূপভাবে সীমান্ত হত্যাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধানেও মনযোগী হতে হবে। দ্রুতই এর সমাধানে অন্তরায়ের পথগুলোকে খুঁজে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গুরুত্বসহকারে সম্মেলন, বৈঠক সবই করতে হবে। তবুও ব্যর্থ হলে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়াই সমীচীন।
লেখক: প্রকৌশলী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন