শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভারতের আগ্রাসী পানিনীতিতে হারিয়ে যাচ্ছে নদী

এইচ এম আব্দুর রহিম | প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মাইকেল মধুসুদনের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ এখন মৃৃৃৃত প্রায়। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় দেশের কপোতাক্ষ নদসহ ১৩ নদী মরে গেছে। কপোতাক্ষ নদে এক সময় ছিল প্রবল স্রোত। নৌকা লঞ্চ স্টিমার চলাচল করত। মাঝিরা পাল তুলে ভাটিয়ালী গান ধরত, এখন তা স্বপ্নের মতো। যশোর থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। এই কপোতাক্ষ নদীর তীরে বটগাছের নীচে বসে মাইকেল মধুসুদন দত্ত সাহিত্য চর্চা করতেন। এছাড়া প্রায় ডজন খানেক নদী মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতির উপর। নদীর পানি প্রবাহের উপর বাংলাদেশের জন্ম, নদী বিপন্ন হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। নদী হারানোর সর্বনাশ ১-২ বছরে, ১-২ দশকে বুঝা যায় না। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি যে কয়েক গুণ বেড়েছে তার হিসাব আমাদের কাছে আছে; নদী কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশে প্রাণ এই নদী নালার কতটা জীবনহানি ও জীবন ক্ষয় হয়েছে, এর ক্ষতির পরিসংখ্যানগত হিসাব আমাদের কাছে নেই। বাংলাদেশের নদীগুলো যেভাবে মরে যাচ্ছে, কারণ হিসাবে ভাগ করলে এর পিছনে তিনটি উৎস্য শনাক্ত করা যায়। এগুলো হলো- প্রথম, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের নদী বিদ্বেষ উন্নয়ন কৌশল এবং তৃতীয়ত দেশের নদী দখলদারদের সাথে প্রভাবশালীদের যোগসাজস। ভারত বাংলাদেশের অভিন্ন নদী ৫৪টি। এ গুলোর সাথে সম্পর্কিত ছোট নদী, শাখা নদীর সংখ্যা ছিল সহস্রাধিক। এখনও দুই শতাধিক নদী কোন রকম বেঁচে আছে। কংক্রিট কেন্দ্রিক তথাকথিত ‘উন্নয়নের বড় শিকার বাংলাদেশের নদী নালা’। বাংলাদেশ অংশে নদীর বিপন্নতা ঘটেছে ভারত তুলনায় অনেক বেশি। কার্যত বাংলাদেশের বৃহৎ চার নদী- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারতের নদী বিধ্বংসী উন্নয়ন যাত্রা গত চার দশকে বাংলাদেশের বৃহৎ নদী পদ্মা ও এ সম্পর্কিত অসংখ্য ছোট নদী, খাল-বিলকে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত করেছে।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংসিত অনেক ইস্যু রয়েছে। বিশেষত অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন প্রশ্নে সমঝোতায় না এসে একতরফা পানি প্রত্যাহার, একতরফা বাজার দখল প্রচেষ্টা, চুক্তি ভেঙে আঙ্গরপোতা দহগ্রাম যাওয়ার তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তর না করা, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি। প্রতিবছর বর্ষা মওসুমে সবগুলো গেট খুলে দেয় ভারত। তীব্র বেগে এসব গেট দিয়ে পানি ধেয়ে এসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জনপদ প্লাবিত করে দেয়। পানির তোড়ে ভেসে যায় দেশের নিম্মাঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের আটটি জেলা প্রতি বছর বন্যায় প্লাবিত হয়। প্রায় প্রতিবছর বর্ষা মওসুমে বিপদ সীমানার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রম্মপুত্র, তিস্তা, মহানন্দা, গড়াই ও কপোতাক্ষ নদের পানি। ভারত উজানে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তার গজল ডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নল কাথা বাঁধ, যশোরের কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলা বন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানী বাঁধ এবং মুহুরী নদীর উপর কলসি বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মওসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে বছরের পর বছর। এ ছাড়া ১৫টি নদীর উপর ভারত অস্থায়ীভাবে কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করে। বর্ষায় এসব অস্থায়ী বাঁধ কেটে দেয়া হয়। অন্যদিকে শুষ্ক মওসুমে দেশের নদ নদীগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়ে। এছাড়া সীমান্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভারত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক ভাঙ্গনের সৃষ্টি করেছে। শত শত কোটি টাকার সম্পদ নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে মুজিব ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী সীমান্ত নদী ভাঙ্গনে ওপারে জেগে উঠে ভূমি ফেরত পাবে না বাংলাদেশ। এভাবে গত সাতচল্লিশ বছরে বাংলাদেশ কম পক্ষে ৫০ হাজার একর ভূমি হারিয়েছে। বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। কিন্তু দেশের মূল্যবান ভূমি ফিরিয়ে আনার যে কোন উদ্যোগেই ভারত আপত্তি জানায়। এসব জানার পর সীমান্ত ভাঙ্গন প্রতিরোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

জানা যায়, সীমান্ত পার থেকে ভারতীয়রা বালি কেটে নিয়ে যাওয়ায় সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই ধরলা, দুধ কুমার, মাতা মুহুরী, আত্রাই, তিস্তা, পদ্ম, গঙ্গা ইছামতিসহ বিভিন্ন সীমান্ত নদীতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার প্রশাসনিক এলাকায় বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ তালপট্টি নামে যে ভূখন্ডটি জেগে উঠেছে। সেটি রোয়েদাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের অংশে হলেও সামরিক শক্তির জোরে ভারত সেটি অপদখল করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টি নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের ভূখন্ড। মরহুম জিয়াউর রহমানের আমলে সর্ব প্রথম বাংলাদেশের দক্ষিণ তালপট্টির ওপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতাশালী ভারতীয় নৌবাহিনী এ দেশের কোন নৌযানকে ওই এলাকায় যেতে দিচ্ছে না। পশ্চিম বঙ্গ সরকার দক্ষিণ তালপট্টিকে ‘নিউ মুর দ্বীপ’ এবং পূর্বাশা নামে অভিহিত করে ভূখন্ডটি তাদের বলে দাবি করেছে। ১৯৮১ সালে ভারত সেখানে তাদের পতাকা উড়ায় এবং একটি অস্থায়ী বিএসএফ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। দক্ষিণ তালপট্টি পুরোপুরি পানির নীচে চলে গেলেও এই অগভীর স্থানে ২৫ থেকে ৩০ বর্গ মাইল বিশিষ্ট ভূমি জেগে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশের ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদের ওপর ভারতের আগ্রাসী তৎপরতার কখনোই অবসান ঘটেনি। একই চিত্র আমরা বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বঙ্গোসাগরের বাংলাদেশ অংশে ও আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারত বন্ধুসুলভ সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে তাদের আধিপত্যবাদী চেহারাটাকেই সাতচল্লিশ বছর ধরে দেখিয়ে এসেছে।

১৯৯৬ সালে ভারতও বাংলাদেশের মধ্যে ন্যূনতম প্রবাহ ৩৪, ৫০০ এবং ২৭,৬৩৩ কিউসেক হারে পানি ছাড়ের দ্বিতীয় চুক্তি হয়। তবে বাংলাদেশকে এই পানি চুক্তিতে ন্যূনতম পানি প্রবাহের কোনো গ্যারান্টি দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো এখন ক্রমশঃ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মরতে বসেছে এবং লবণাক্ততা সুন্দর বন এলাকা ছাড়িয়ে ক্রমশঃ উজানের দিকে উঠেছে। গঙ্গা নদীর পানি প্রবাহের দ্বিতীয় চুক্তির পর ভারতের সাথে অন্যান্য নদীগুলোর পানি বণ্টনের কথাও আসতে থাকে। প্রথমেই আসে তিস্তার কথা। ঐতিহাসিকভাবে, তিস্তার পানি আসে হিমালয়ের হিমবাহগুলো থেকে, যার সাথে যোগ দেয় গতি পথের ঝর্ণা ও নদীগুলোর প্রবাহ। এই প্রবাহ বসন্ত আসার আগে বাড়তে থাকে যখন তাপ বৃদ্ধির কারণে তুষার হিমবাহগুলো গলতে শুরু করে। বর্ষার অতিবৃষ্টি অনেক সময় ভাটির ডুয়ার্স সমতলে বন্যা সৃষ্টি করে। ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তিস্তার পানি সর্ম্পকে লিখেছেন, এন্ডারসন সেতুর তলায় এই প্রবাহ অনেক সময় ৯০ কিউসেকে নেমে আসে। এই সেতুটি দার্জিলিং কালিম পং সড়কে অবস্থিত যার ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে সিভক শহরের কাছে তিস্তা নদী ডুয়ার্সের সমতলে প্রবেশ করেছে। তারও ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মিত। গজলডোবার ৬৫ কিলোমিটার ভাটিতে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের কাউনিয়া রেল সেতুর কাছে গড়ে ২০০ কিউসেক প্রবাহ পাওয়া গেছে। কিন্তু এই ব্যারেজের কাছে এই প্রবাহের পরিমাণ ১,০০০ কিউসেক থেকে ৪০০ কিউসেকের মতো। ভারত ১৯৮২ সালে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার শুরু করে যার ফলে বাংলাদেশের তিস্তা নদী ও তিস্তা প্রকল্প মার খেতে থাকে।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর উল্লেখযোগ্য অংশ শুকিয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন পানি প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরাঞ্চলের কৃষি। সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্ত পানির উপর, যা দীর্ঘ মেয়াদে আর ও জটিল প্রতিবেশগত সংকট তৈরি করছে। শুধু তাই নয় পদ্মা নদীর এই ক্ষয় তার সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোকে দুর্বল করেছে, যার প্রভাব পড়েছে সুন্দর বন পর্যন্ত। সুন্দরবনের কাছে নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে তাতে ক্ষয় হচ্ছে পারি নির্ভর বনের জীবন। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশ নয় পশ্চিমবঙ্গের আশে পাশে পড়েছে। একদিকে পানি শূন্যতা, অন্যদিকে অসময়ের বন্যা এবং অতিরিক্ত পলি। সম্প্রতি বিহারের মানুষ শাবল নিয়ে মিছিল করেছে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার দাবিতে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও এই বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতাও ভারতের বাঁধকেন্দ্রিক উন্নয়ন ব্যবসায়ী তাদের পৃষ্ঠপোষক বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠিকে থামাতে পারেনি। তাছাড়া ভারতের শাসকদের চিন্তা পদ্ধতিতে ভাটিরদেশ বাংলাদেশের অধিকার বিষয় একবারে অনুপস্থিত। মনিপুরে টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তÍতি পুরোটাই চলেছে একতরফাভাবে। এই বাঁধ বাংলাদেশের আরেক বৃহৎ বড় নদী মেঘনার জন্য যে বড় হুমকি হবে তা বাংলাদেশ ভারতের স্বাধীন বিশেজ্ঞরা অনেক আগে থেকে বলে আসছেন। ভাটির দেশকে না জানিয়ে গজলডোবা বাঁধ দিয়ে যেভাবে একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা স্পষ্টই আর্ন্তজাতিক আইনের লঙ্ঘন। গ্রীষ্মে তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানির অভাবে খা খা করে। তিস্তার পানি প্রবাহ এখন দশ শতাংশ নেমে এসেছে। ফারাক্কা ও গজলডোবা ছাড়া ও মনু নদীতে নল কাথা বাঁধ, যশোরের কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চামখা ঘাচ বাঁধ, বাংলা বান্দা মহানন্দা নদীর উপর মহারাণী বাঁধ এবং মুহুরি নদীর উপর কালসি বাঁধসহ আর ও ১৫-২০টি বাঁধ কার্যকর রয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ভারত বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পৃথিবীর বৃহৎ নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি ১৪টি খননকৃত খালের মাধ্যমে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রবাহিত করা হবে। এটি কার্যকর হলে অন্যান্য নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের আর একটি বৃহৎ নদী যমুনা আক্রান্ত হবে।শুকিয়ে যাবে নদী উপনদী। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের নদ নদী খাল অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পানি প্রবাহের উপর পঞ্চাশ দশক হতে ভারতের ধারাবাহিক আক্রমণ এসেছে উন্নয়ন নামক বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে। এই প্রকল্প করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার। ঋণের টাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধা সম্প্রসারন বাঁধসহ নির্মানমুখী কর্মসুচি হিসেবে। দেখা গেছে এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি লক্ষ্য হিসেবে ঘোষনা করা হলেও এক পর্যায়ে বন্যা নিয়ন্ত্রন হয়নি, সেচ সুবিধা কাজ করেনি এবং মূল লক্ষ্য খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধকেন্দ্রিক উন্নয়ন বা নির্মান কাজ বিদেশি ঋণের টাকায় হয়। ফলাফল যাইহোক, ঋণদাতা, কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, আমলা এবং ভুমি দস্যুদের লাভ অনেক। এর অনেক দৃটান্ত আছে। এখানে শুধু একটা দৃটান্ত দেই। বড়াল নদী বাংলাদেশের দুই প্রধান নদী পদ্মাএবং যমুনার সংযোগ নদী। দৈঘ্যর্ প্রায় ২০৪ কিলোমিটার, ১২০ মিটার প্রস্ত এর অববাহিকা৭৭২ বর্গকিলোমিটার। এরই সঙ্গেচলন বিল। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এর মুখে সুইজ গেট, ক্রস ড্যাস, বক্সকালভাট নির্মাণ করা হয়। অন্য প্রকল্প গুলোর মতো এটিও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, নৌপথ সম্প্রসারণ লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।প্রথম তিন বছর ভালো উৎপাদন দেখা যায়। এর পর শুরু হয় বিপর্যয়। ফারাক্কার কারণে পদ্মার প্রবাহ কম ছিল। উপরন্তু বড়াল নদীর মুখে সুইজ গেট বসানেরার কারনে পদ্মা থেকে আসা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। স্রোত কমে যায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। যমুনা যেখানে বড়াল গিয়ে মেশে, সেখানে পানি প্রবাহ নিম্ন স্তরে নেমে যাওয়ায় যমুনা নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভাঙ্গন বিস্তৃত হয়। অববাহিকায় প্রায় এক কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা এখন হুমকির মুখে। বড়াল শুকিয়ে যে জমি উঠেছে, তা এখন নানা জনের দখলে। তৃতীয়ত বিভিন্ন নদীর মরন দশা হলে ক্ষমতাবান ব্যক্তি গোষ্ঠির লাভ। দুর্বল হয়ে গেলে জমি ক্রমাগত জীতে রূপান্তরিত লাভ করে। তখন তা দখল করা সহজ হয়। নদী বাঁচলে তার মূল্য টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু তার থেকে উঠে আসা জমির পরিমাণ শত হাজার কোটি হয়ে যায়। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় নদী একটি আর একটির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠির যোগাযোগের মাধ্যম নৌপথ। স্বাধীনতার পর বিআইডবিব্লিটিএ যে জরিপ করে, তাতে বাংলাদেশের নদী পথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজারকিলোমিটার। অর্থাৎ দেশের মোট আয়তনের ৭ শতাংশ।শুস্ক মওসুমে তা আরো নিচে নেমে আসে। ইতোমধ্যে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে ২০ হাজার কিলোমিটার নদী পথ হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ১৩টি নদী।আর ও সাতটি নদী মৃতপ্রায়। এসব নদী দেশের অর্থ নৈতিক প্রবাহকে সচল করে রাখে। নদী পথে মালামাল বহন ও লোকজন চলাচল কমে গেছে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে যেখানে দেশের মোট পরিবহন ক্ষেত্রে নৌ পথে যাত্রী পরিবহন ১৬ শতাংশ ও মালামাল পরিবহন ৩৭ শতাংশ ২০০৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮ ও ১৬ শতাংশ।সড়ক পথের তুলনায় নৌ পথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ঝুঁকি অনেক কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০০সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নৌপথে ৩২৫টি র্দুঘটনায় প্রাণ হারায় ২৪৫৫ জন যাত্রী। গড়ে প্রতি বছর ১৬৪ জন মারা গেছে। সড়ক পথে প্রতি বছর গড়ে ৪০০০জন মারা যায়, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আর ও বেশি। গত চার দশকে ভারতের নদী বিধ্বংসী উন্নয়ন যাত্রা এদশের বৃহৎ নদী পদ্মা ও এ সর্ম্পকিত অসংখ্য ছোট নদী, খাল বিল কে বিপর্যয় করেছে। প্দ্ম নদী শুকিয়ে গেছে। এদিকে বর্ষা মওসুমে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় উপকূলীয় বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে বর্তমানে উপকূলীয় বাঁধগুলো এত জরাজীর্ণ যে এসব এলাকার কোটি কোটি মানুষ চরম আতংক উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। শুধু সাতক্ষীরা, খুলনা উপকূলীয় এলাকায় সাড়ে ৮শত কিলোমিটার ওয়াপদা বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কোন মুহূর্তে এসব বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গোসাগরের তরঙ্গমালা হতে রক্ষা করার জন্য মূলত: এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এসব বাঁধের স্থায়িত্ব ধরা হয় বিশ বছর। কিন্তু ৪০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও যথাযতভাবে এসব বাঁধ সংস্কার করা হয়নি। ফলে বিশাল বিস্তৃত এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেন্বর হারিকেন ঝড়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেন্বর সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় উপকূলীয় এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। প্রায় তিনশতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে, হাজার হাজার বসত বাড়ি নদীর সাথে বিলীন হয়ে যায়। এর পর থেকে উপকূলীয় বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এসব বাঁধগুলো সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। এদিকে বহু নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওযায় অর্থনৈতিক সংকটের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরের নদীগুলো পানি ধারণ করতে না পারায় বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে হাজার বিঘা জমি বর্ষা মওসুমে অনাবাদী থাকছে। বর্ষা মওসুমে লোকালয় রক্ষা করার জন্য যে সব বাঁধ ইতিপূর্বে নিমার্ণ করা হয়েছিল, তা এখন সংস্কার করা দরকার। নইলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন