সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : নিয়মমাফিক চলছে না কোনো কিছুই। চারদিকে শুধুই চলছে লুটপাট আর অনিয়মের মহোৎসব। দেশের শেয়ার মার্কেট থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল। লুটেরাদের কেশাগ্র স্পর্শ করা গেল না। হলমার্ক, ডেসটিনি, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও বিসমিল্লাহ গ্রæপের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হলো। এসবেরও কোনো ক‚লকিনারা হলো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি করেছে সংঘবদ্ধ দেশি-বিদেশি একটি চক্র। এ নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও হালে যা শুরু হয়েছে তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, কথিত তদন্তের নামে এসব জাতীয় খাদকদের দায়মুক্তির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের এমন নেতিবাচক মানসিকতার কারণে এসব লুটেরা এখন অনেকটাই বেপরোয়া। তারা একটার পর একটা সফলতা পাচ্ছে এবং নতুন নতুন প্রকল্পও গ্রহণ করছে। বিচারহীনতার কারণেই তারা এখন অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য। হালে শনির আছর লেগেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ওপরও।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ভুয়া কোম্পানি ও ব্যাংক হিসাব খুলে জালিয়াতির মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ইউরোপা গ্রæপের নয়টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অংকের এ টাকা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা রিপোর্টে আর্থিক এ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এতদিন বিষয়টি গোপন রাখা হয় কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দিলে ঘটনাটি জানাজানি হয়। জানা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের তেজগাঁও শিল্প এলাকা শাখায় ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য নিয়মবহিভর্‚ত কাগজপত্র দিয়ে খোলা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৭৩ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে ইউরোপা গ্রæপের চেয়ারম্যান। এর মধ্যে পটেটো ফ্ল্যাক্স বিডি লিমিটেডের অনুক‚লে ৬৯ কোটি ৬২ লাখ, ইউরোপো কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের ১৭ কোটি ৫৪ লাখ, মাহিন নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজের ২৭ কোটি ১ লাখ, সাথী অ্যাপারেলস ৬ কোটি ৮৬ লাখ, তিষাম অ্যাপারেলস ৩২ কোটি ২৩ লাখ ও শিহাব গার্মেন্টের ১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটের ঘটনায় দোষীদের শনাক্ত নয় বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পনুরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ নিয়েই কাজ করছে তদন্ত কমিটি। ফলে দোষীদের শনাক্ত করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল তাতে ভাটা পড়েছে। প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভাবশালী একটি চক্র কাজ করছে। অভিজ্ঞমহল মনে করছে, সবই আই-ওয়াশ। বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চলমান সব প্রক্রিয়া দায়ীদের দায়মুক্তি দেয়ার অপকৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয়।
মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই দাবি করেছে, অর্থ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক দোষ চাপাচ্ছে সুইফট ও ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের ওপর। এর মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। মূলত রাষ্ট্রীয় অর্থের তদারকি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ চুরির সঙ্গে যদি সেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত থাকে, তাহলে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর তা করতে ব্যর্থ হলে আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
মূলত ফিলিপাইনের প্রচেষ্টায় ব্যবসায়ী কিম অংয়ের কাছ থেকে কিছু ডলার উদ্ধারের দাবি করা হয়েছে। ফিলিপাইনের এএমএলসি (অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল) অর্থ পাচারের জন্য কয়েকজনকে শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দোষীদের শনাক্ত করতে পারেনি। আসলে রিজার্ভ লুটের তিন মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্টে সিস্টেমে আরটিজিএস স্থাপনে নিরাপত্তা ফায়ারওয়াল ফেলে দেওয়া ও ১০ মাস পূর্বে ২০১৫ সালের মে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থের সিংহভাগ যারা ফিলিপাইনের একটি ব্যাংক হয়ে ক্যাসিনোয় পাচার করেছিলেন, তাদের সবাই এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তদন্তে দেশটির ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকেও (এনবিআই) যুক্ত করা হয়নি পুরো মাত্রায়। সিনেটে যে শুনানি শুরু হয়েছিল, গত সপ্তাহে তাও শেষ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। জানা গেছে, ফিলিপাইনের ক্যাসিনোগুলো অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের আওতায় পড়ে না। ফলে খেলোয়াড়দের অর্থের উৎসের ব্যাপারে সরকারকে তথ্য দিতে বাধ্য নয় তারা। এটিই তদন্ত ঝিমিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জুয়ার ব্যবসাকে জমিয়ে তুলতে ২০১৩ সালে ফিলিপাইনের কংগ্রেস ক্যাসিনোগুলোকে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
রিজার্ভ চুরির তদন্তেও দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্বাবিরোধিতা স্পষ্ট। মূলত তদন্ত চলছে সরকার নির্ধারিত ছকে এবং ফরমায়েসী স্টাইলে। ফলে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধী শনাক্ত করার পরিবর্তে সময় ক্ষেপণ এবং এক সময় পুরো ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে বলেই মনে হয়।
এদিকে ব্রিটেনের ডেইলি মেইল রিজার্ভ চুরির বিষয়ে নতুন বোমা ফাটিয়েছে। বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পেছনে মূল হোতারা রয়েছে ভারতে। এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা করে। আর এটা একজনের নয়, কয়েকজনের কাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন