দেশের আমদানী-রফতানী ও ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফ লাইন হিসেবে গণ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে দুর্ভোগ যেন বেড়েই চলেছে। রমজানের আগে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যখালাস ও সারাদেশে সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যস্ততা থাকায় এ সময়ে এ মহাসড়কে যানবাহন সমাগম বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে সাধারণত প্রত্যেক ঈদের আগে এই মহাসড়কে মাইলের পর মাইল দীর্ঘ যানজট দেখা যায়। যানজট নিরসনের লক্ষ্যে মহাসড়কটিকে দুই লেন থেকে চারলেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরুর পর থেকে এই মহাসড়কে জনদুর্ভোগ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫ সালে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় প্রথম এই মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ শুরুর পর ৬ বছরে কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে চার দফায় সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৩ হাজার ৮১৭ কোটি টাকায় বর্ধিত করার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ১১ বছর পেরিয়ে এসেও শেষ হয়নি। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের বিকল্পহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে এই মহাসড়কের উন্নয়ন কাজই যেন সকলের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বাণিজ্য, অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তাসহ পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের এই প্রধান সড়কে বছরের পর বছর ধরে এমন বেহাল দশা মেনে নেয়া কষ্টকর। চারলেনে উন্নীত করার নামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ক্রমবর্ধমান যানজট ও জনদুর্ভোগ ভুক্তভোগীদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার প্রকল্প ব্যয়ের তুলনায় সময়মত কাজ শেষ করতে না পারায় দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে বহুগুণ বেশী।
সাম্প্রতিক রোয়ানুর অজুহাতে একশ্রেণীর ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়েছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটে ৫ ঘণ্টার পথ ৮ ঘণ্টায় পেরোনোর ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়ার মাশুলও পরোক্ষভাবে ভোক্তাদেরই দিতে হয়। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মঙ্গলবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকা প্রান্তের কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতি সেতুর উভয় পাশে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়ে পরিবহন যাত্রীরা। সাধারণত ঈদের আগের দিনগুলোতে এ মহাসড়কে জনদুর্ভোগ বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড দেখা গেলেও এবার ঈদের অনেক আগেই অস্বাভাবিক যানজটের সম্মুখী হচ্ছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রীরা। এগার বছর অতিক্রান্ত ফোরলেন প্রকল্পের কাজের জন্য রাস্তার একপাশ বন্ধ রাখার কারণে এই জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। যানজট ও জনদুর্ভোগ বৃদ্ধির জন্য ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতাকেও দায়ী করছেন ভুক্তভোগী যাত্রীদের অনেকে। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেই নয়, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল মহাসড়কেও একই রকম বাস্তবতা বিদ্যমান। বছরের পর বছর পেরিয়ে দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও শেষ হয়না উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। ভুল পরিকল্পনা, ভুল নকশায় প্রকল্প বাস্তবায়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাস্তা ও সেতু নির্মাণে সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশী ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয় বাংলাদেশে। ইউরোপে চারলেনের নতুন হাইওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ২ কোটি টাকা, ভারতে এ ব্যয় ১ কোটি টাকা, চীনে ১ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশে চলমান তিনটি মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার প্রকল্পে গড়ে খরচ পড়ছে প্রতি কিলোমিটারে ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চারলেন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ৯৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে বলে জানা যায়। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হওয়া সত্তে¡ও সড়ক নির্মাণে উন্নত দেশের চেয়েও কয়েকগুণ বেশী ব্যয় হয় কিভাবে তার কোন ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই। মূল প্রকল্প গ্রহণের সময় থেকে বাস্তবায়নের শেষ পর্যন্ত বার বার সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির পরও কোন কোন মেগা প্রকল্পে ভুল নকশা ও নিম্নমান ধরা পড়ছে। দেশের মানুষ যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চায়। সরকারও জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বছরে লক্ষকোটি টাকা উন্নয়ন বাজেট গ্রহণ করছে। তবে উন্নয়নের নামে সড়ক-মহাসড়কে এমন দুর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা অনাকাক্সিক্ষত। মহাসড়ক বা উড়ালসেতুর মত হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই সম্ভাব্য সব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ফিজিবিলিটি রিপোর্ট যাচাই করার কথা। যেখানে প্রকল্প গ্রহণের আগে ফিজিবিলিটি রিপোর্টসহ নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শক নিয়োগে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, সেখানে ৬ বছরের প্রকল্প প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে ১১ বছরেও শেষ করতে না পারার কারণ প্রকল্প পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা। দেশের মানুষ অনতিবিলম্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পের সফল পরিসমাপ্তি দেখতে চায়। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিসহ সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এমন অপচয় ও জনদুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায় জনগণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন