দেশের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণের সিংহভাগ কাজ পেয়েছে ভারতীয় মুদ্রণ কোম্পানীগুলো। আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রণের জন্য জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক আহ্বানকৃত আন্তর্জাতিক দরপত্রে ৯৮টি লটের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৫৮টিই পেয়েছে তিনটি ভারতীয় মুদ্রণ কোম্পানী। এছাড়া একটি দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানী ১৪টি এবং একটি চীনা কোম্পানী দু’টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে বাংলাদেশী পাবলিশিং হাউজগুলো সম্মিলিতভাবে অবশিষ্ট ২৪টি লটের কাজ পেয়েছে গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, চলতি শিক্ষাবর্ষের জন্য দেশের প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি শিক্ষার্থীর কাছে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ১০.৪৫ কোটি বই ছাপা, বাঁধাই ও সরবরাহের পেছনে ৩৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও দেশীয় ২২টি কোম্পানী সম্মিলিতভাবে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ২২ কোটি টাকায় দরপত্র দাখিল করে বই সরবরাহ সুসম্পন্ন করেছিল। তবে বইয়ের কাগজ ও ছাপার মান নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক মহলে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে। এবারের আন্তর্জাতিক দরপত্রে দেশী-বিদেশী চার শতাধিক প্রিন্টিং কোম্পানী অংশগ্রহণ করলেও তিনটি ভারতীয় কোম্পানী সিংহভাগ কাজ বাগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে এ খাতে ভারতীয় আধিপত্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হল। এর ফলে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবী করছেন। ২০১০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক পাঠ্যবই মুদ্রণ কাজে দেশীয় মুদ্রণ শিল্পকে ভারতীয় কোম্পানীগুলোর সাথে একটি অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
আকাশ সংস্কৃতি এবং অনলাইনভিত্তিক তথ্যপ্রবাহের কারণে ইতিমধ্যেই দেশের মুদ্রণশিল্পের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের মন্দা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশের ৫ হাজারের বেশী প্রিন্টিং হাউজের সাথে চার লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি যুক্ত রয়েছে। এ খাতে বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশী ব্যবসা থাকলেও গত কয়েকটি শিক্ষাবছরে ব্যবসা কমতে কমতে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। তথ্যমতে, বর্ধিত কলেবরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়ার সরকারী পরিকল্পনা গ্রহণের সাথে সাথে বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণে ২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের ঘোষণা দিয়ে মূলত ভারতীয় কোম্পানীগুলোকে বাংলাদেশী পাঠ্যপুস্তক ছাপার ব্যবসা বাগিয়ে নেয়ার রাস্তা করে দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক ইতিপূর্বে কখনোই বিদেশী মুদ্রণশিল্পের উপর নির্ভর ছিলনা। বর্তমান সরকার বিনামূল্যে বই সরবরাহের কলেবর বৃদ্ধির শুরুতেও সিংহভাগ পাঠ্যপুস্তক দেশীয় মুদ্রণ কোম্পানীগুলোই বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল। এখন প্রাথমিক স্তরের ৯৮টি লটের বই ছাপার কাজের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই ভারতীয় ও বিদেশী কোম্পানীগুলো লাভ করায় বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
দেশীয় মুদ্রণশিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও লাখ লাখ শ্রমিকের স্বার্থকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এমনিতেই দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের খরা চলছে। সেখানে দেশীয় মুদ্রণ শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষা করে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ বিদেশী কোম্পানীগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়া কোন অজুহাতেই সঙ্গত নয়। পক্ষান্তরে এই প্রশ্নও উঠে আসছে যে, ভারতীয়, কোরীয় ও চীনা কোম্পানীগুলো অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ নিলেও বাংলাদেশী পাবলিশিং হাউজগুলো তা’ পারছেনা কেন? এবার বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিকের ১০.৫৩ কোটি পাঠ্য পুস্তকের জন্য ৩৫০ কোটি টাকার ব্যয়-বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই অর্থ গতবছর দাখিলকৃত দরের চেয়ে ১৩০ কোটি টাকা বেশী। দেশীয় পাবলিশিং হাউজগুলোর সক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থে দেশীয় পাবলিশিং হাউজগুলোর পক্ষে মানসম্পন্ন কাগজ ও মুদ্রণে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ অসম্ভব নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের শর্তে অথবা ভিন্ন কোন অজুহাতেই দেশীয় মুদ্রণশিল্পে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের স্বার্থ সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল উদাসীন থাকতে পারেনা। দেশীয় শিল্পরক্ষা এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সরকারী সহায়তা এবং নজরদারি না থাকা দুঃখজনক। জাতীয় স্বার্থের নিরিখে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অগ্রাহ্য করে দেশীয় মুদ্রণশিল্পকে ধ্বংস করার সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তক খাতের শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন