এটিএম বুথ থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে কিছুদিন আগে ছয় জন ইউক্রেনীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী।
পুলিশ জানিয়েছে তারা আন্তর্জাতিক এটিএম জালিয়াত চক্রের সদস্য। ঈদের ছুটি কে কাজে লাগিয়ে এই চক্র হাতিয়ে নিয়েছে এটিএম বুথ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা। ঈদে এটি এম নিরাপত্তা ঢিলেঢালা থাকে আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে এই চক্রটি।
জুন মাসের প্রথমদিনে ডাচ বাংলা ব্যাংকের কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে পুলিশ ছয় জন ইউক্রেনীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করে।
এরপর পুলিশ কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও ঐ চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
শুরুতে ছয় লাখ টাকা লোপাটের কথা জানা গিয়েছিল, পরে পুলিশ জানিয়েছে, কার্যত প্রায় ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জালিয়াতরা।সেসময় ডাচ বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিন বিবিসিকে জানিয়েছেন, জালিয়াত চক্রের সদস্যরা খুবই আধুনিক কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা তুলে নিচ্ছিলো।
"এরকম প্রযুক্তি আমরা কখনো দেখিনি বা শুনিনি। প্রথম যখন এটিএম বুথে এই জালিয়াতি হয়, আমাদের কর্মীরা চেক করে দেখেছে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন হয়নি।এমনকি কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বেরিয়ে যায়নি। যেটা হয়েছে, সেটা হলো এটিএমের ভল্টে যে টাকা ছিল, সেখান থেকেই ক্যাশ বা নগদ টাকা বের করে নিয়ে গেছে তারা। ওরা এমন একটা কার্ড ব্যবহার করেছে, যার সঙ্গে কোন গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এটা সরাসরি মানি ডিসপেন্সার থেকে টাকা বের করে নেয়া যায়। এটা সম্ভবত এ সংক্রান্ত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি।"
এখন ডাচ বাংলা ব্যাংকের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এবং এটিএম বুথের নিরাপত্তা দুটোই বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন যা সংক্ষেপে এটিএম মেশিন নামে পরিচিত তা চালু করা হয়েছিল।তারপর এই মেশিন দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।
এই মূহুর্তে সারা দেশে দশ হাজারের বেশি এটিএম বুথ রয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি বুথ ডাচ-বাংলা ব্যাংকের।
এই সব বুথে ব্যাবহৃত হচ্ছে ডেবিট, ক্রেডিট,ইন্টারন্যাশনাল কার্ড। যার ব্যাবহার নিশ্চিত হয় অনলাইনে।
এই অনলাইনে যে আমাদের একাউন্ট হ্যাক হয়েছে কি না? কিভাবে হতে পারে এই এটিএম হ্যাক? এই প্রশ্নের জবাবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি উপায়ে একটি এটিএম বুথ হ্যাক হতে পারে।
জ্যাকপট ম্যালওয়্যার দিয়ে চুরিঃ
তানভীর জোহা জানিয়েছেন, হ্যাকাররা আমাদের এটিএম বুথ জালিয়াতির ঘটনাতা ঘটিয়েছে একদম নতুন পন্থায়। হ্যাকাররা জ্যাকপট ম্যালওয়্যার এর মাধ্যমে এটিএম থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিয়েছে।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন সম্ভব যা কোন একাউন্ট এর টাকা নয় সরাসরি এটি এম এ রাখা টাকা।
কার্ড স্কিমিং:
কার্ড স্কিমিং বাংলাদেশে গত কয়েকবছর ধরে শোনা যাচ্ছে, হ্যাকাররা এটিএম মেশিনে একটি ছোট্ট যন্ত্র স্থাপন এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট একাউন্ট এর তথ্য হাতিয়ে নিয়ে যায়।
এ ধরণের কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটার পর ২০১৬ সালে গ্রাহকের কার্ডের সুরক্ষা দিতে প্রতিটি এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস বসানো বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মিঃ জোহা বলছেন, ঐ ঘটনার পর সব ব্যাংক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেও জালিয়াত চক্রও বসে নেই।
"সর্বশেষ ঘটনাটাই এর প্রমাণ।"
কার্ড ক্লোনিং:
এ ব্যবস্থায় কোন ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের যাবতীয় তথ্য কপি করে নেবার পর নতুন একটি কার্ডে মোবাইল ফোনের সিমের মত একটি চিপ স্থাপন করে ক্লোনিং করা সম্ভব।
মানে হুবহু আরেকটি কার্ড তৈরি করা যাবে এবং এ ব্যবস্থাতেও নির্দিষ্ট একটি অ্যাকাউন্টের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আরেকজনের কাছে।
শপিং মলের মেশিনে কার্ড রিডার থাকতে পারে?
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মিঃ জোহা বলছেন, আমরা শপিং মলে নিজেদের কার্ডের মাধ্যমে বিল দিয়ে থাকি যাতে আমাদের কার্ডের নিরাপত্তা মারাক্তক ভাবে ব্যাহত হতে পারে।
সেখানে কার্ড রিডারের মাধ্যমে কার্ডের সব তথ্য হাতিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যার মাধ্যমে একটি ক্লোন কার্ড বানানো সম্ভব।
এমনকি সেটা দিয়ে অনলাইনে আনলিমিটেড কেনাকাটা করা সম্ভব।"
কার্ড রিডার নানা আকারের হতে পারে, অত্যাধুনিক কার্ড হতে পারে এমনকি পাতলা পলিথিনের মত একটি পরত দেয়া।
মানে বিল দেয়ার যে মেশিন, তাতে একটা পলিথিনের মত পাতলা স্তরও হাতিয়ে নিতে পারে আপনার কার্ডের সব তথ্য।"
এজন্য গ্রাহককে খেয়াল রাখতে হবে বিল দেয়ার যে মেশিন যেন স্বাভাবিক থাকে, কোন আলগা কিছু না থাকে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ কার্ড ব্যাবহার কারীরাই সচেতন নন তারা যেকোন জায়গায় কার্ড ব্যাবহারে কোন নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেন নাহ।
সচেতনতা আসে যখন এই কার্ড চক্রের মাধ্যমে ক্ষতি ও হয়রানি সম্মুখিনের পর।
তেমনি একজন নাজিয়া পারভীন, যিনি একজন শখের মডেল, যিনি সন্তানের স্কুলের বেতন, গৃহস্থালি বাজারঘাট এবং পোশাকআশাক কেনার ক্ষেত্রে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে থাকেন।
তিনি বলছেন, "দুই তিন বছর আগে যখন প্রথম কার্ড জালিয়াতির কথা শুনেছি, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখন কয়েকদিন টিভিতে খবরে, টকশোতে এবং ওয়েবসাইটগুলোতে খালি খুঁজেছি গ্রাহকের নিরাপত্তার পথ কী।"
"এখনো আমি সাবধান থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু প্রতিটা লেনদেনের সময় তো আর মেশিনের সাথে কিছু জুড়ে দেয়া আছে কিনা তা দেখা হয় না।"
জ্যাকপট ম্যালওয়্যার দিয়ে যখন চুরি হয়, তখন যেহেতু কোন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করতে হয়না, ফলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননা। যে কারণে এখানে একজন ব্যক্তির চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সচেতন হবার প্রয়োজন বেশি।
তবে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সাধারণ নিরাপত্তার জন্য তানভীর জোহা বলছেন, এখনো বাংলাদেশে এটিএম মেশিন থেকে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে এক স্তর নিরাপত্তা অর্থাৎ কেবল পাসওয়ার্ড দিয়ে টাকা তোলা যায়।
এর বদলে যদি টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন মানে পাসওয়ার্ড দেবার পর মোবাইল বা অন্য কোন যন্ত্রে ব্যাংক থেকে পাঠানো আরেকটি কোড সরবারহ করা হয়, এবং সেটি ব্যবহার করে গ্রাহক টাকা তুলতে পারবেন, এমন ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে নিরাপত্তা জোরদার হবে।
কার্ড স্কিমিং ঠেকানোর জন্য একজন গ্রাহক যখনই এটিএম মেশিনে কোন লেনদেন করবেন তার খেয়াল করতে হবে এটিএম মেশিনের কি-প্যাডের ওপর বা পাশে কোন ছোট্ট যন্ত্র আছে কিনা।এছাড়া পাসওয়ার্ড গোপন রাখতে হবে। কখনোই অন্যের সাথে শেয়ার করা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন