কিছুদিন আগেও বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচয় মিলত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে। এসব অপবাদ কাটিয়ে এরপরেই রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে এদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের ভূমিকা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয় মানবিকতার দেশ হিসেবে। তার সাথে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে বিশ্ব মিডিয়া ও রাজনীতি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এত মানবিকতা ও সহনশীলতার দেশটি এবার নতুন করে দানবীয় কার্যকলাপে বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করছে। কারণ দেশে দিবালোকে প্রকাশ্যে ছুরি-রামদা দিয়ে কুপিয়ে, রড বা হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে ও পুড়িয়ে হত্যার মহোৎসব চলছে। প্রতিটি ঘটনার নৃশংসতা ও বর্বরতা তার পরের ঘটনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া এই সব হত্যার ঘটনা এখন যেন একটা প্রথা বা সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে। মানবতার প্রতি এ যেন এক চরম উপহাস। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় প্রতিপক্ষকে কুপিয়ে বা গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, পারিবারিক কলহে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে, প্রেমঘটিত বিষয়ে মনমালিন্য বা সম্পর্ক ভাঙ্গাগড়ার জেরে খুন, মা-বাবার হাতে সন্তান খুন বা তার উল্টোটা, এমনকি তুচ্ছ ঘটনায় কেরোসিন বা পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা ইত্যাদি ঘটনা দেশের নানা প্রান্তে অহরহ ঘটছে। অপরাধ বিশেজ্ঞরা বলেছেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অপরাধীদের ছাড় পাওয়া, মাদকাসক্ততা ও অর্থনৈতিক কারণে এসব নারকীয় ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে।
ছোট বা বড় রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক, প্রেম ঘটিত, পারিবারিক বা অর্থনৈতিক সে যে ধরণের কারণই হোক তাই বলে হত্যা করতে হবে! হত্যা কখনোই কোন সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচনার যোগ্য হতে পারে না। আমরা মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হলেও আমাদের মানবতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। একেকটা ঘটনায় দোষীদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের ব্যর্থতায় আজও আমরা দুর্বল অবস্থানেই রয়েছি। একেকটি ঘটনা যেন উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে পরবর্তী ঘটনা ঘটাতে। সাম্প্রতিককালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনাই উদাহরণ। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় দেশ হত্যাকারীদের অভয় আশ্রমে পরিণত হবে। দেশে সম্প্রতি আলোচিত কিছু ঘটনার মাঝে উল্লেখযোগ্য- সিলেটে খাদিজা হত্যা, কুমিল্লায় তনু হত্যা, ফেনীর সোনাগাজির মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা, বরগুনা শহরে দিন দুপুরে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে শাহনেওয়াজ রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা এবং গত ৩০ জুন বিকাল ৫ টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ এলাকায় মুহসিন নামের যুবলীগ কর্মীকে নিজ দলের লোকেরা হত্যার চেষ্টায় নৃশংসভাবে পিটিয়েছে। এছাড়া দেশে ন্যাক্কারজনক ঘটনা হিসেবে বিভিন্ন বিদেশী নাগরিক হত্যাকান্ডও ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনার ভিডিও চিত্র ফেসবুকে ধারাবাহিকভাবে ভাইরাল হওয়ায় দেশ-বিদেশে আতংক ও উদ্বেগের সৃষ্টির পাশাপাশি আমাদের ভাবম‚র্তি বিশ্ব দরবারে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
তার আগে বিগত সময়েও বহু আলোচিত, অমানবিক ও বর্বর শিশু হত্যাকান্ড দেশে ঘটেছে। যেমন- হবিগঞ্জের বাহুবলে ৪ শিশুকে হত্যা যার শিরোনাম হয়েছিল সিএনএন এবং আল-জাজিরা টিভিতে। এছাড়া সিলেটে পায়ু পথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু শ্রমিক রাজনকে হত্যা, খুলনায় অনুরুপভাবে রাকিবকে, পাবনায় বিসিক শিল্প নগরীতে শ্রমিক দুলাল হোসেনকে, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় নির্মাণ শ্রমিক ধনু মিয়াকে এবং বগুড়ায় টাইলস কারখানায় শিশু শ্রমিক রাসেলকে হত্যা করা হয়। দেশে এমন সব বর্বরতার উদাহরণ স্বরূপ হত্যার ঘটনাগুলো নজির হিসেবে থাকলেও বিচারের তেমন নজির নেই বললেই চলে। আমাদের আইনি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণেই বারবার এসব ঘটনার মাধ্যমে অপশক্তির বেপরোয়া মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। কারণ অপরাধীরা পার পেয়ে যায় বা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রশ্রয়ে। সা¤প্রতিক বছরগুলোর হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান অনেক বড় যা রীতিমত গাঁ শিউরে উঠার মত। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারাদেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। এর মধ্যে ২০১৩ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছেন ৩ হাজার ৯৮৮ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৬ সালে ৮৭৯, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৫৪৯ জন আর তারপর থেকে চলতি সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া খুনের পরিসংখ্যান এখনও জানা যায় নি। এছাড়া দেশে শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের পরিমাণও বেড়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৪১% যা আশঙ্কাজনক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষিত হয়েছে ৪৯৬টি শিশু যেখানে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এই সংখ্যা ছিল ৩৫১টি। ধর্ষণকারীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ষাট বছরের বৃদ্ধা থেকে শুরু করে ছয় বছরের শিশু পর্যন্ত। কিছু অসাধু আইন ব্যবসায়ীরা নৈতিকতা ও বিবেককে বিসর্জন দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আইনে ফাঁক-ফোঁকর তৈরি করে এই ধর্ষণকারী, হত্যাকারীদের পার পাইয়ে দিচ্ছে ফলে অপরাধীরা দ্বিগুণহারে নির্ভয়ে অপরাধ করছে। আমাদের সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ইতোমধ্যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে বেশ কিছু স‚চকে অপরাধের মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে এসেছে। তবে কারনে-অকারনে বা তুচ্ছ ঘটনায় অবলীলায় দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া এইসব হত্যার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণে এখন পর্যন্ত তেমন কোন বিবেচনাযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি। আমরা ইদানিং দেখেছি, বেশ কয়েকটি ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে শক্তিশালী ভ‚মিকা নিয়েছেন, প্রশাসনকে কঠোরভাবে নানা রকম নির্দেশনা দিয়েছেন। এমন হস্তক্ষেপের ফলে দোষীরা শাস্তি পাবেই এমন প্রত্যাশা ভুক্তভোগী পরিবার ও দেশবাসীর। অর্থাৎ অপরাধ কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি গোছর হলেই দ্রুত ট্রাইব্যুনালে সঠিকভাবে বিচার নিষ্পত্তি হয় আর বাকীগুলোকে নানাভাবে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ভাবতে অবাক লাগে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরই কেবল রিফাত, নুসরাতদের পরিবার দ্রুত বিচার পাচ্ছে অন্যথায় হয়ত সেগুলোও ঝুলে থাকতো। দেশে আইন থাকা সত্তে¡ও প্রয়োগের বেলায় কেন এত গড়িমসি? বারবার কেন রাষ্ট্রের একজন ব্যস্ত ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যাক্তির নির্দেশনার অপেক্ষা প্রশাসনকে করতে হবে? তাই এখনই এই সব হত্যা কমাতে আমাদের এই জীর্ণশীর্ণ এবং গতানুগতিক আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রয়োগ সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। আমরা মনে করি প্রতিটি হত্যার কঠোর শাস্তি স্বরূপ বড় ধরণের নজির রাখা উচিৎ যাতে করে পরবর্তী ঘটনা ঘটানোর আগে যে কাউকে শতবার শাস্তির কথা ভাবতে হয়। মধ্য প্রাচ্যের দেশ সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে ধর্ষণ, হত্যা বা চুরি-ডাকাতির শাস্তি বড়ই কঠোর। হত্যার শাস্তি হিসেবে ফাঁসি বা দিবালোকে জনসাধারণের সামনে শিরোচ্ছেদ বা অঙ্গ কর্তনের মত শাস্তির বিধান রয়েছে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ-প‚র্ব এশিয়ার দেশ ব্রুনাইয়েও প্রায় অনুরূপ শাস্তির বিধান রয়েছে। ফলে এই সব কঠিন শাস্তির ভয়ে সে সব দেশে আমাদের মত এত সহজেই একের পর এক এমন নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটছে না।
তাই অবাধে, কারণে-অকারণে এই সব হত্যা বন্ধে আমাদেরকেও হয়ত অনুরূপভাবে তেমনই কিছু ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রয়োজন সক্ষমতা অর্জন। জনগণ চায় কাগজ কলমে ও কথায় সীমাবদ্ধ না রেখে, স্বজনপ্রীতিকে এড়িয়ে দ্রুত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সঠিক বিচার ও শংকামুক্ত বাসযোগ্য পরিবেশ।
লেখক: প্রকৌশলী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন