শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মৃত মানুষের পাশে বসে কান্না করাই যাদের পেশা

ইসমাইল মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ভারতের রাজস্থানে বিচিত্র পেশার এক সম্প্রদায় বাস করেন। তারা হলেন ‘রুদালি’ সম্প্রদায়। বহুকাল ধরেই ওই সম্প্রদায়ের মহিলাদের একমাত্র পেশা হলো ভাড়াটিয়া হিসেবে মৃত ব্যক্তির জন্য চোখের জল ঝরানো! আর এই পেশাতেই জীবিকা নির্বাহ করেন রাজস্থানের ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের বেশকিছু নারী। ওই নারীরা কালো পোশাক পরে রাজস্থানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। কোথাও কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কাঁদার জন্য তাদের ডাক পড়ে। কোনো মানুষ মুমূর্ষু অবস্থায় থাকলেও কালো পোশাকের ওই নারীদের পূর্ব থেকেই ভাড়া করে রাখেন মুমূর্ষু ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা। মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পন্ন হবার পর তাদের দায়িত্ব বা কাঁদার কাজ শেষ। তবে কোনো কোনো বাড়িতে তিনদিন পর্যন্ত ভাড়াটিয়া রুদালিদের দিয়ে কান্নার আয়োজন করে থাকেন রাজস্থানের জমিদার শ্রেণির মানুষ। বুক চাপড়ে, মাটি চাপড়ে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে হৃদয় বিদারক বা করুণ সুর করে বিলাপ করে কান্নাকাটি করার সময় রুদালিদের কান্না দেখতে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। করুণ সুরে তাদের কান্না দেখে অনেক সময় কাঁদেন মৃত ব্যক্তির পাড়া-প্রতিবেশীরাও।

সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি অদ্ভুত পেশা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় ভারতের রাজস্থানে কয়েকশ’ বছর ধরে টিকে রয়েছে রুদালি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।

‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীরা কালো কাপড় পরিধান করেন। শত শত বছর ধরে তাদের বিশ্বাস যমদূতের পছন্দের রঙ হলো কালো। তাই যমদূতকে খুশি করতেই ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীরা কালো রঙের পোশাক পরিধান করেন। তাদের পেশার মতোই তাদের ব্যক্তিগত জীবনপুঞ্জিও। রাজস্থানের মানুষের কাছে ‘রুদালি’ সম্প্রদায় তথাকথিত নিচু বর্ণের। সমাজে তাঁদের বিয়ে করার অনুমতি নেই। কারণ তাঁরা যদি বিয়ে করে ঘর সংসারী হয় তবে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে আর কান্না করবে না। আর মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার আয়োজন না করলে মৃতের আত্মা কষ্ট পাবে। তাই রুদালিদের বিয়ে করার উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

এখন জেনে নেয়া যাক মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন থাকতে কেন রুদালিদের দিয়ে মরা বাড়িতে কান্নার আয়োজন? রোর বাংলা নামক একটি অনলাইন গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, একজন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রের মানুষ মৃতের খবর পেলে ভিড় জমান। সমাজের উচ্চবর্ণের নারীদের অন্য বর্ণ-গোত্রের মানুষের সামনে নিজেদের আবেগ-অনুভূতি প্রদর্শনের অনুমতি নেই রাজস্থানে। উচ্চবর্ণের নারীরা বাড়ির অভ্যন্তরেই স্বাভাবিকভাবে থাকতে হবে। এ কারণে তাদের নিজেদের হৃদয়ের জমানো চরম দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটান এই ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীরা।

‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের মরা বাড়িতে কান্নার এই পেশা সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু রাজস্থানের বেশকিছু জনগোষ্ঠীর কাছে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং শত শত বছর ধরে চলে আসা চরম সত্য ও ঐতিহাসিক। ‘রুদালি’ নারীদের মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে সব সময়ই লিঙ্গ, জাত, শ্রেণি, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়।

এই ‘রুদালি’ কারা? রাজস্থানে যদি কেউ নিচু বর্ণের মানুষ হয় এবং ওই মানুষটি যদি অর্থনৈতিক টানাপোড়নে থাকেন তাহলে তাদেরকে রুদালি হতে বাধ্য করেন উচ্চবর্ণের পরিবারগুলো। জমিদারী শাসনামলে অনেক সময় দরিদ্র প্রজাদের রুদালি হতে বাধ্য করতেন জমিদাররা। এ প্রথা এখনো বিদ্যমান। সমাজের উচ্চবর্ণের বা জমিদার শ্রেণির মানুষ নিচু বর্ণের দরিদ্রদের রুদালি হতে বাধ্য করছে। তাঁদের চোখের জল টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই কি-েন নিতে পারে জমিদার শ্রেণির তথাকথিত ওই মানুষগুলো। ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের কেউই কখনোই নিজেদের ইচ্ছেয় এ পেশায় আসেননি। শত শত বছর ধরে সমাজের জমিদার শ্রেণির লোকজন দরিদ্র বা নিচু বর্ণের লোকজনদের ‘রুদালি’ হতে বাধ্য করে চলেছে। এক কথায় বলা যায় সমাজের উচ্চবর্ণ এবং নিচু বর্ণের যোজন যোজন ফারাক বা প্রকারভেদই রাজস্থানী সমাজে ‘রুদালি’ নামের ওই সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে চলেছে। জমিদার শ্রেণি বা উচ্চ বর্ণের মানুষের কাছে ‘রুদালি’রা প্রায়শই শোষণ-নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীদের অনেকেই উচ্চবর্ণের ব্যক্তিদের অবৈধ সন্তানের জন্ম দেন। এ যেন রুদালিদের ললাটের লিখন। বিয়ে না করেও সমাজের উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিদের সন্তানের মা হচ্ছেন তারা। তবে রুদালি নারী যদি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন তবে ওই সন্তানও ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়ে থাকে। কারণ ওই কন্যা সন্তান বড় হবার পর তাকেও রুদালি সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। তাই রুদালি নারীরা মনে করেন, কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়া রুদালি সমাজের জন্য অভিশাপস্বরূপ। তাঁদের মধ্যে একটি প্রবাদ যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রয়েছে। প্রবাদটি হলো ‘পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি নায়েক’। এ প্রবাদের অর্থ হলো- খালি পায়ে মাইলের পর মেইল হেঁটে যাওয়াও ততটা কষ্টকর নয়, যতটা কষ্ট কন্যাসন্তান ঘরে এলে হয়। তবে রুদালি নারী উচ্চ বর্ণের ব্যক্তির অবৈধ পুত্র সন্তান যদি জন্ম দেন ওই পুত্র সন্তানও ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়েন। কারণ রুদালি নারী পুত্র সন্তান জন্ম দিলেও তাকে পিতৃ পরিচয় ব্যবহার করার কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। ওই পুত্র সন্তানরাও শত শত বছর ধরে সমাজের চোখে ‘অবৈধ’ সন্তান হিসেবেই পরিগণিত।

উচ্চ বর্ণের পরিচয়হীন মানুষের মৃত্যুতে মাটিতে গড়াগড়ি, বুক চাপড়ে বা যত আবেগের সাথেই কান্নাকাটি রুদালিরা করুক না কেন তাদের মজুরী মেলে নামমাত্র। সেইসঙ্গে শত শত বছরের ঐতিহ্য হিসেবে রুদালিদের জন্য বরাদ্দ থাকে দুটি বাসি রুটি আর একটি কাঁচা পেঁয়াজ। তবে বর্তমানে কোনো কোনো পরিবার রুদালিদের এক বেলা ভাত খেতে দেন এবং কালো রঙের পরনের একটি কাপড় দান করেন।

‘রুদালি’ নারীরা মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নাকাটির জন্য চোখে জল আনতে এক ধরনের পাহাড়ি গাছের শিকড় ব্যবহার করে থাকেন। এ শিকড় গ্লিসারিনের মতো কাজ করে। চোখে লাগানোর সাথে সাথেই চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। তবে কেউ কেউ চোখে এক ধরনের কালি ব্যবহার করেন। এ কালি থেকে তীব্র জ্বালা অনুভূত হয়। এ কারণে চোখ থেকে আপনাআপনি জল পড়তে শুরু করে। কোনো কোনো সময় মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে রুদালিরা নিজেদের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা মনে করে সত্যিকার অর্থেই চোখের জল ফেলেন। তাদের নিরব এ কান্না দেখে না কেউ।

রাজস্থানের ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের জীবন কাহিনী অবলম্বনে ১৯৯৩ সালে ভারতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ ছবিতে রুদালি সম্প্রদায়ের জীবনালেখ্য’র বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। ছবিটির চিত্রনাট্যে লিখেছিলেন গুলজার ও কল্পনা লাজমী। পরিচালনা করেন কল্পনা লাজমী। ছবিটির মূল বা নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন ডি¤পল কাপাডিয়া। এছাড়া ছবিটিতে অভিনয় করেন রাজ বাব্বর ও রাখী। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ভুপেন হাজারিকা। ছবিটি ১৯৯৩ সালের ১৮ জুন মুক্তি পায়। এ ছবিটি ডি¤পল কাপাডিয়াকে যথেষ্ঠ খ্যাতি এনে দেয় এবং তিনি এ ছবির সাফল্যেই রূপালী পর্দায় তাঁর আসন পাকাপোক্ত করে নেন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক
ismail.press2019@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন