সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কুখ্যাত রাজপালের ‘রঙ্গিলা রসূল’ গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু অভিমত

মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

কাদিয়ানী কবলিত ভারতে যখন আশেকে রসূল (সা.) আমিরে শরীয়ত সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বোখারী এর নেতৃত্বে শীর্ষ স্থানীয় উলামা মাশায়েখ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ খতমে নবুওয়াত আন্দোলন জোরদার করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে ছিলেন এবং কাদিয়ানী বিরোধী সংগ্রামকে বেগমান করে তুলে ছিলেন, ঠিক সেই সময় নতুন একটি উৎপাত শুরু করা হয়েছিল এক শ্রেণীর হিন্দু লেখকের পক্ষ হতে। সে বিগত শতকের তৃতীয় দশকের কথা। রাজপাল নামক এক কুখ্যাত লেখক মহানবী (সা.) এর পবিত্র চরিত্র কলঙ্কিত করে ‘রঙ্গিলা রসূল’ নামক পুস্তক রচনা করে ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান মুসলমানদের মনে দারুণ আঘাত করে। মুসলমানদের রোষানলের এ চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যে দুই জন মুসলিম যুবক কুখ্যাত রাজপালকে হত্যা করে ফাঁসির কাষ্ঠে শাহাদাতকে সন্তুষ্ট চিত্তে বরণ করে নিয়ে ছিলেন, তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশের বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সেই সময়কার বিভিন্ন তথ্য অনেকেরই জানা থাকার কথা। এ আন্দলনের সূচনা লগ্নে লাহোরে অধ্যয়নরত একজন বাংলাদেশী তরুণের ভ‚মিকার কথাও হয়তো অনেকের অজানা নয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রবীণ রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তার আত্মজীবনীতে তিনি সে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন বলে স্বয়ং ব্যাক্ত করেছেন। যেমন- তাঁর রচিত ‘শিরাজী স্মৃতি’ গ্রন্থে ‘রঙ্গীলা রসূল’ শিরোনামে উক্ত ঘটনাটির কথা এই ভাবে বর্ণনা করেছেন; মুসলমান হিসেবে শিরাজী সাহেব নিজেকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে করতেন। ইসলাম ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই ধর্মের একজন অনুসারী হিসেবে তিনি নিজের আত্ম-মর্যাদার ব্যাপারে ছিলেন খুবই সচেতন। শেষ নবী (দ.) এর প্রতি তাঁর ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ। এক দিনের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে।

আহমদিয়া (কাদিয়ানী) মতবাদের জনৈক প্রচারক শিরাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি পাঞ্জাবের কাদিয়ান গ্রামের মীর্জা গোলাম আহমদ সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য পেশ করেন। মীর্জা গোলাম আহমদ কোরআনের বিধানের অনুগত থেকেও যে নবী, তা তিনি যুক্তি প্রমাণের দ্বারা শিরাজী সাহেবকে বুঝাবার চেষ্টা করতে থাকেন। শিরাজী সাহেব নীরবে শুনছেন। তাঁর বক্তব্য শেষ হলে শিরাজী সাহেব মাথা উঁচু করে একটু উষ্ণভাবে বললেন, ‘আমেনার বেটাকেই অনেক কষ্টে মানি, পাঞ্জাবে আবার নবী আসলো।’ এ কথা শুনে প্রচারক ভদ্রলোক বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লেন।

সম্ভবত; ১৯২৬ সালে, একদিন বিকেল বেলা তিনি ‘ষ্টেটস্ম্যান’ পত্রিকা পড়তেছিলেন। হঠাৎ খবরের কাগজটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্রোধান্বিত স্বরে বলতে লাগলেন; ‘আমার রসূল রঙ্গিলা, আমার রসূল রঙ্গিলা। এত বড় স্পর্ধা!’ তিনি অস্থির হয়ে পায়চারী করতে লাগলেন আর ঐ একই কথা বার বার উচ্চারণ করতে লাগলেন। ক্রোধে তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে।

‘ষ্টেটস্ম্যান’ পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছিলো যে, লাহোরের আর্য সমাজভুক্ত রাজপাল নামক জনৈক ব্যক্তি, ‘রঙ্গিলা রসূল’ নামে একটি পুুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। উক্ত পুস্তিকায় বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) কে জঘন্যভাবে গালাগাল করা হয়েছে। তাঁকে ‘রঙ্গিলা রসূল’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। শিরাজী সাহেব এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, সারারাত একটু ঘুমাতে পারলেন না। বার বার এসে ছেলে, আসাদদ্দৌলাকে ডেকে বলছিলেন, ‘আসাদ! আসাদ! তুই এই প্রতিশোধ নিতে পারবি না?’ আর নিজের মনে আওড়াচ্ছিলেন ‘আমার রসূলকে রঙ্গিলা রসূল বলেছে!’

শিরাজী সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র আসাদ্দদৌলা তখনো কিশোর। পরে আমি স্নেহাষ্পদ আসাদের মুখেই এ ঘটনার কথা শুনেছি। আমি তখন লাহোরে। সেখানে ‘রঙ্গিলা রসূল’ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে আমি অংশগ্রহণ করি। এই বিষয়টি আমার আত্মজীবনীতে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি। যা হোক, শিরাজী সাহেব ধর্ম বিশ্বাসে অত্যন্ত উদার ছিলেন এবং অন্যান্য সকল ধর্মের উপর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু আপন ধর্ম বিশ্বাসে তিনি অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন। এখানে কোন অন্যায় আঘাত তিনি বরদাশ্ত করতেন না। আগুনের মত জ¦লে উঠতেন। (পৃষ্ঠা: ৪৪-৪৫)

‘মাসিক মহানাগরিক’ পত্রিকায় মওলানা তর্কবাগীশ ‘স্মৃতি নয় ইতিহাস’ শীর্ষক শিরোনামে এ লেখক উল্লেখ করেছিলেন: এক হিন্দু লেখকের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের কথা বহু আগে থেকেই শুনে আসছিলাম। কিন্তু বিস্তারিত বিবরণ তেমন কিছুই জানতাম না। মওলানা তর্কবাগীশের মুখে এবং তাঁর ‘স্মৃতিকথা’ থেকে জানতে পারি যে, এ ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘রঙ্গিলা রসূল’ নামে একখানা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল লাহোরে। একজন আর্য সমাজী রাজপাল প্রকাশিত এ পুস্তকে অমার্জিত ভাষায় হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর কল্পিত চরিত্র অংকিত করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে রাজপালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে তার আইনজীবী বক্তব্য রাখে যে, ‘রঙ্গিলা রসূল’ বইটির জন্য মুসলমানরা বিক্ষুদ্ধ হলে তারা নিশ্চয়ই আজ আদালতে উপস্থিত হতেন। যেহেতু তারা উপস্থিত নেই এতে প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসের উপর আঘাত করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ হতে যে মামলা দায়ের করা হয়েছে তা সঠিক নয়। ঘটনাক্রমে মামলার অবস্থা দেখতে ঐ সময় মওলানা তর্কবাগীশ উপস্থিত ছিলেন। তিনি কলেজ হোস্টেলে ফিরে আদালতের ঘটনা সবাইকে বললেন। সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আগামী শুক্রবারে শাহী মসজিদে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। কিন্তু শুক্রবারের তখনও কয়েকদিন দেরী দেখে মওলানা তর্কবাগীশ সে দিন রাতেই কয়েকটি মসজিদে তারাবীর নামাজীদের কাছে আদালতের ঘটনা বর্ণনা করেন। মওলানা সাহেবের বক্তব্য শুনে মুসলমানগণ আবেগ উত্তেজনায় ফেটে পড়েন। তাঁকে ঘিরে ধরে সবাই জানতে চাইল, ‘বলুন কি করতে হবে?’ মওলানা সাহেব বললেন, ‘এ খবর প্রত্যেক মুসলমানদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আগামী তারিখে মুসলমানদের প্রমাণ করতে হবে যে, আকায়ে নামদার মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর উপর আমাদের ভক্তি ভালবাসা কতটুকু। প্রয়োজনে শত সহস্র জান কোরবান করে দিতে হবে।’ একজন বাঙালী তরুণ মুসলমান ‘রঙ্গিলা রসূল’ পুস্তকের বিরুদ্ধে এক তুমুল আন্দোলনের নায়ক হয়ে উঠলেন। মওলানার এই তদবীর-পরামর্শ দ্রুত কাজ করে এবং পরের দিনই কলেজ ছাত্র ও শত শত লোক প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মওলানার বাণী পৌঁছে দেয়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই পাঞ্জাবের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, মওলানার বাণীর আগুন, সৃষ্টি হলো বিক্ষোভ অসন্তোষের এক প্রবল উদ্দীপনা। পরিণতিতে রাজপালের ১৪ বছর কারাদন্ড এবং ‘রঙ্গিলা রসূল’ বাজেয়াপ্ত হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে আপীল করে রাজপাল নির্দোষ বলে খালাস পায় এবং ‘রঙ্গিলা রসূল’ এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এর ফলে সারা ভারতে ভয়ংকর উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিলো, যার মূলে ছিল মওলানা তর্কবাগীশের ভ‚মিকা। (পৃষ্ঠা: ৫৮-৫৯)

পরবর্তীকালে দৈনিক ইনকিলাবে ঘটনাটি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিগত শতকের শেষ দিকে দৈনিক ইনকিলাবের ‘মতামত’ কলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ছাপা হয়েছিল, যার লেখক ছিলেন সৈয়দ আশরাফ আলী (মরহুম)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালক। প্রকাশিত ‘তথ্য সরবরাহের অনুরোধ’ শীর্ষক চিঠি খানার অংশ বিশেষ আলোচনার সুবিধার্তে নিন্মে তুলে ধরা হল: ‘১৯৩২ সালের ৯ মার্চ তারিখে কলিকাতায় দুই বীর মুজাহিদের মহাপ্রায়াণ ঘটে। হত্যার অপরাধে আমীর আহমদে ও আবদুল্লাহ খান নামক দুই ক্ষণজন্মা মোমেনকে কলিকাতায় ফাঁসি দেয়া হয়। ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর নিস্কলঙ্ক, পুত-পবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপনকারী কুখ্যাত রঙ্গীলা রসূল এর রচয়িতাকে প্রকশ্যে দিবালোকে হত্যা করার দরুন আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানকে ফাঁসির মঞ্চে শাহাদাত বরণ করতে হয়।

রঙ্গীলা রসূল গ্রন্থটি কলিকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এর লেখক ও প্রকাশকের নাম সম্ভবত: ছিল শ্রদ্ধানন্দ। সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আহমদ মুজতবা মোহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর পবিত্র চরিত্র সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর ও অশালীন মন্তব্য উক্ত গ্রন্থে বিধৃত হয়। ২১ বছর বয়স্ক আমীর আহমেদ ছিলেন অমৃতসর নিবাসী এক কর্মকার। তাঁর বন্ধু ১৯ বছর বয়স্ক আবদুল্লাহ খান ছিলেন লাহোর নিবাসী একজন শিক্ষিত সূত্রধর। স্বাধীনচেতা এই যুবকদ্বয় চাকরি অপেক্ষা তাদের বংশগত পেশাকেই শ্রেয় মনে করতেন বিধায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাঁরা জীবিকা অর্জনে ছিলেন অধিকতর আগ্রহী।

‘রঙ্গীলা রসূল’ এর ঘৃণিত অপপ্রয়াসের সংবাদ তাঁদের কানে পৌঁছালে তাঁরা এই অমার্জনীয় অপরাধের জন্য কুৎসা রটনাকারীকে কঠোরতম শাস্তি দেবার বজ্রদীপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। লাহোর থেকে ট্রেনযোগে তাঁরা কোলকাতায় পৌঁছে প্রকাশকের দপ্তর খুঁজে বের করেন এবং লেখক প্রকাশককে দিবালোকে সর্বসমক্ষে হত্যা করেন। পলায়নের বিন্দুমাত্র কোন প্রয়াস তাঁরা গ্রহণ করেননি। পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে তাঁরা সহজ সরলভাবে জানান যে, এ হত্যাকান্ড সুস্থ মস্তিষ্কে, ধীর-স্থিরভাবে সাধিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁরা কৃতজ্ঞ যে, এ মহতী প্রয়াসে তাঁরা সফল হয়েছেন। তাঁরা একথাও ঘোষণা করেন যে, ভবিষ্যতেও কোন ব্যক্তি প্রিয় নবী (সা.) এর মহান চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের ঘৃণিত প্রয়াস নিলে তাঁরা অবশ্যই তাকেও চরম শাস্তি দেবার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা চালাবেন।

তদানীন্তন আইন গগনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্ক শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক মহান মুজাহিদদ্বয়ের মুক্তির নিমিত্তে আপ্রাণ প্রয়াস চালান। কিন্তু কৌসুলিবৃন্দসহ বিভিন্ন মহলের শত অনুরোধ-উপরোধ সত্তে¡ও রসূলের এই মহান একনিষ্ঠ অনুসারীদ্বয় এ কথা ঘোষণা করতে অসম্মত হন যে, তাঁরা উত্তেজিত হয়ে “রঙ্গীলা রসূল” এর প্রকাশককে হত্যা করেছেন। আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় তাঁরা দাবি করেন যে, পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনা অনুযায়ীই তাঁরা ধীর-স্থিরভাবে অত্যন্ত স্বাভাবিক মন-মানসিকতা নিয়ে অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করেছেন। মোমেন মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য পালন করেছেন। তাঁরা এর জন্য গৌরবান্বিত। অনুতপ্ত বা দুঃখিত নন।

আদালতের রায়ে ফাঁসি দেয়া হয়, ১৩৫০ হিজরীর ৩০ শাওয়াল (৯ মার্চ, ১৯৩২) তারিখে রাত্রি ৩টা ১৫ মিনিটে। কালিকাতস্থ মুসলিম গোরস্থান গোবরাতে এই শহীদদের পবিত্র মাজারে আজও প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য, তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করার জন্য। শহীদ আমীর আহমেদ ও শহীদ আবদুল্লাহ খান সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা অপরিপার্য বলে আমি মনে করি। পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিজ্ঞ সহৃদয় পাঠক অনুগ্রহ পূর্বক এ বিষয়ে আলোকপাত করলে ইসলামের এই নগণ্য খাদেম বাধিত হবেন।

শহীদদ্বয়ের বংশ পরিচিতি, হত্যাকান্ডের তারিখ, ক্ষণ ও স্থান, আসামী পক্ষের কৌসুলিদের বিস্তারিত তালিকা, সংশ্লিষ্ট আদালত ও বিচারকের পরিচয়-পরিচিতি, যে জেলে ফাঁসি কার্যকর করা হয় তার নাম ইত্যাদি সম্পর্কে কোন বিজ্ঞ পাঠকের কোন তথ্য জানা থাকলে সে তথ্য অনুগ্রহপূর্বক পরিজ্ঞাপন করার জন্য সবিনয়ে স্বনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালকের এই পত্র খানা দৈনিক ইনকিলাবের মতামত কলামে প্রকাশিত হওয়ার পর এর প্রতি সাড়া দিয়ে ডাক যোগে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ আসে, যা ‘রঙ্গিলা রসূল’ এর শহীদদ্বয়ের সম্পর্কে শিরোনামে ইনকিলাব এর ‘ফোরাম’ পাতায় দুই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যাটি ২৩/১১/১৯৯৪ এবং দ্বিতীয় সংখ্যাটি ২৮/১২/১৯৯৪ ইং তারিখ। এই দীর্ঘ প্রবন্ধ হতে সামান্য উদ্ধৃতি নিম্নরূপ: ‘কোলকাতার পার্কসার্কাসের পার্কের পূর্বে অনতিদূরে গোবরা রোডের পাশে গোবরা কবরস্থান অবস্থিত। গোরস্থানের কর্মচারীদের মধ্যে আমার এক আত্মীয় ঐ রাত্রিতে প্রায় রাত ৯টার দিকে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি খুব চিন্তিত। ঐ রাত্রিতে নাকি ঐ গোরস্থানে দু’জন ফাঁসির আসামির জোড়া-কবর হবে। তাই এস.পি. বা ডি.এস.পি সহ দু’জন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার রাত ১২টার দিকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে করব দুটো প্রস্তুত করিয়ে রেখে যাবেন। শহীদ বন্ধু না হলে, এমন জোড়া কবর হয় না। জোড়া পাকা কবর গাঁথার জন্য ইট ইত্যাদি সরঞ্জাম সবই প্রস্তুত করে রাখা আছে, কেবল দাফনের অপেক্ষা।

পার্কের উত্তর পাশের রাস্তার উপর পাশেই আমাদের বাসা। পরদিন ভোরে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পরপর দুটো পুলিশের খোলা ট্রাকে করে কড়া পুলিশ প্রহরায় শহীদদের দুটো লাশ নিঃশব্দে গোবরা গোরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। সকাল ৮/৯ টার মধ্যে যেন সমস্ত গোরস্থান মানুষের গুঞ্জরণে ভরে গেল। গোরস্থানের ভিতরে ঢুকতেই, প্রথমেই একটা লাশ রাখার টিনের ছাউনি। সেখানেই শহীদদ্বয়ের লাশ। ছাউনির দুই কিনারে, বা পাশাপাশি দু’টি খাটিয়ায় দুই লাশের গলা থেকে মাথা পর্যন্ত আলগা করে রাখা ছিল। সকলের একনজর দেখার জন্য।’

রচনার শেষ দিকে লেখক উল্লেখ করেন: ‘লাশ দুটো দেখে মনে হলো যেন, দু’জনারই চেহারা প্রায় এক রকম, যেন আপন সহোদর। একই প্রকার শ্যামবর্ণ, লম্বা, চওড়া-চ্যাপটা সুঠাম দেহ, গোলগাল মাথা-মুখমন্ডল, মাথায় কালো যেন ছোট করে ছাঁটা চুল। দু’জনার মুখেই কালো চাপদাড়ি। দু’জনাই যেন হাসিমুখে ঘুমিয়ে আছে। অত লোকের স্থান সংকুলানের অভাবে আমাদেরকে গোরস্থানের বাইরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো শহীদদের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের আসার জন্য। শেষ পর্যন্ত প্রায় বেলা ১০/১১ টার দিকে একটি বিরাট চারদিক ঢাকা সাদা গাড়ীতে করে তাঁরা হাজির হলেন। গাড়ীর ভেতরের মেয়েদের কান্নার রোলে যেন সকলের হৃদয় ভেঙ্গে পড়ল ও সকলের চোখই অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল।’

এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে আগ্রহী অনুসন্ধিৎসু গবেষকদের সুবিধার্থে আমরা উপরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু তথ্য ও সূত্র উপস্থাপন করেছি এবং শহীদদ্বয়ের রসূল প্রেমের যে বিস্ময়কর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা প্রত্যেক নবী (সা.) প্রেমিক মুসলমানকে উজ্জীবীত করবে। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত ‘রঙ্গিলা রসূল এর শহীদদ্বয় সম্পর্কে’ প্রবন্ধটি এই ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে পাঠকবর্গকে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে। যা লেখাটি মৌলিক সূত্র হিসেবে গণ্য হতে পারে। (এ সম্পর্কে আরও নানা তথ্য বিবরণ রয়েছে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন