যানজট নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর তিনটি প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের অবহেলায় ব্যস্ত প্রধান তিনটি সড়কে এখনও রিকশা চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রগতি সরণীর রামপুরা এলাকায় পুলিশের সামনেই রিকশা চলতে দেখা গেছে। দিনে হালকা-পাতলা চললেও রাতে শত শত রিকশার কারণে যানজট লেগে ছিল রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত বহাল আছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও বলেছেন, প্রধান সড়কে রিকশা চলবে না। চলবে বাইলেনে। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার পরেও কিভাবে প্রধান সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত রিকশা চলছে-এ প্রশ্ন ভুক্তভোগিদের। তাদের প্রশ্ন- নিষিদ্ধ ঘোষণার পরেও রিকশা চলাচলের দায় কার?
রিকশা বন্ধের বিষয়ে দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়াতেই ব্যস্ত ট্রাফিক পুলিশ। তারা বলছে, এটা দেখভালের দায়িত্ব তাদের একার না, সিটি করপোরেশনেরও। সিটি করেপোরেশন বলছে, তারা বিষয়টি নিয়ে এখনও চিন্তা-ভাবনা করছে। সরকারের এই দুই সংস্থার সমন্বয়হীনতায় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের রিকশা-ভ্যান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তের সুফল পাচ্ছে না রাজধানীবাসী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে বৈধ রিকশার সংখ্যা প্রায় ৮৭ হাজার। অথচ পুরো রাজধানীজুড়ে চলছে প্রায় ১১ লাখ। এই ১১ লাখ রিকশার নম্বরপ্লেট বাণিজ্য থেকে বছরে আয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পকেটে যাচ্ছে এই টাকা। মালিকপক্ষ এজন্য জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগসহ কমপক্ষে ৩০টি সংগঠনকে দায়ী করেছে। তবে জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী গতকাল ইনকিলাবকে বলেছেন, তারা ৪৩ হাজার রিকশার নম্বরপ্লেট দিয়ে থাকেন। এই বাইরে মুক্তিযোদ্ধার নামে বিভিন্ন ভূয়া সংগঠন লাখ লাখ নম্বরপ্লেট বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সরেজমিনে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে রামপুরা, মালিবাগ ও সায়েদাবাদ এলাকায় দেখা গেছে, আগের মতো বেশি না হলেও প্রধান সড়কে পুলিশের চোখের সামনেই রিকশা চলছে। কুড়িল থেকে শাহজাদপুর, মধ্যবাড্ডা, মেরুল বাড্ডা হয়ে রামপুরা আসছে রিকশা। আবার রামপুরা থেকে মালিবাগ হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশা চলাচল করছে। জানতে চাইলে মালিবাগ এলাকায় দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক পুলিশ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। প্রধান সড়কে রিকশা দেখলে সেগুলোকে ভিতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপরেও মাঝে মধ্যে দু’চারটে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, সিটি কর্পোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকই। সব দায়-দায়িত্বতো পুলিশের নয়। তারা আপোষ করবে নাকি সিদ্ধান্তে অটল থাকবে সেটা ক্লিয়ার করতে হবে। তিনি বলেন, শুধু পুলিশ দিয়ে রিকশা তাড়ালে তো হবে না। মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এ্যাকশনে যেতে হবে। কয়েকজনকে জেল-জরিমানা করলে তবেই না রিকশা চলাচল বন্ধ হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সার্জেন্ট বলেন, প্রথম দিন তো মোবাইল কোর্ট ছিল। এরপর থেকে আর তো দেখা যাচ্ছে না।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগিরা জানান, গতকাল সকালের দিকে হালকা-পাতলা চললেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুড়িল থেকে মালিবাগ-সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রধান সড়কে রিকশার সংখ্যা বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার পর একেবারে স্বাভাবিক নিয়মে সড়কে চলতে থাকে রিকশা। রাত ৮টার দিকে রিকশার কারণে রামপুরা ও মালিবাগ এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। একই অবস্থা মধ্য বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকায়ও। এ অবস্থা চলতে থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
তবে আজিমপুর থেকে মিরপুর, সায়েন্সল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়ক ছিল অনেকটাই ব্যতিক্রম। এই দুই সড়কে খুব বেশি রিকশা দেখা যায়নি। এই দুই সড়কে ট্রাফিক পুলিশকেও বেশ সচেতন মনে হয়েছে বলে জানান বিভিন্ন পরিবহনের চালক ও যাত্রীরা।
প্রধান সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা কার্যকর করার পর রিকশার রিকশা চলাচলের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে দুদিন নৈরাজ্য চালিয়েছে রিকশাচালকরা। এ নিয়ে দুই সিটির মেয়র রিকশা শ্রমিক নেতাদের সাথে আলোচনা করে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান সড়কে রিকশা চলবে না। এমনকি দুই বছরের মধ্যে ঢাকায় কোনো রিকশা চলবে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, প্রধান সড়কে যানজটের অন্যতম কারণ ধীরগতির যানবাহন রিকশা। পৃথিবীর কোনও শহরে এমন অবস্থা নেই। আমরা অবৈধ যানবাহন বন্ধ, ফুটপাত দখলমুক্ত ও অবৈধ পার্কিং বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গঠিত কমিটি দুটি প্রধান রুটে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুরো শহর থেকে রিকশা উঠিয়ে দেওয়া হয়নি। মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, এই শহরকে বাঁচাতে হবে। জনগণের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। সেজন্য জনগণের স্বার্থেই রিকশা বন্ধ করা হয়েছে। ডিএসসিসি মেয়র অভিযোগ করে বলেন, কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তি রিকশাচালকদের সামনে রেখে পরিস্থিতি উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনড় অবস্থানে আছি। ওই রুটগুলোতে রিকশা চলতে দেওয়া হবে না।
এর আগে গতকাল বুধবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানী ঢাকার মূল সড়কে রিকশা চলাচল করতে পারবে না। যেসব সড়কে বাইলেন রয়েছে সেখানে বাইলেন দিয়েই রিকশা চলবে। এ ব্যাপারে আমাদের আগের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে।
তবে রিকশা বন্ধের প্রথম দিন থেকেই আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য শুরু করে রিকশাচালক ও মালিকরা। তাদের দাবি, প্রধান সড়কগুলোতেও তাদের চলাচলের অনুমোদন দিতে হবে। তবে রিকশাচালক-মালিকদের এই দাবি মানতে নারাজ দুই সিটি করপোরেশন। সংস্থা দুটি বলছে, মূল রাজধানীর প্রায় ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র ২০-২৫ কিলোমিটারের মতো সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। ফলে রিকশাচালকদের মূল কর্মক্ষেত্রে কমে যায়নি, পর্যাপ্ত রয়েছে। নগরীতে মেট্রোরেলসহ উন্নয়ন কাজের কারণে প্রধান একটি সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়ায় যানজট নিয়ন্ত্রণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রিকশা বন্ধ করায় সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোতে যানবাহনে গতি কিছুটা ফিরেছে। বাসচালকরা জানান, রিকশা ধীরগতির হওয়ায় এতদিন সড়কে যানজট ছিল। রিকশা কমে যাওয়ায় এখন যানবাহনের গতিও ফিরেছে, ট্রিপও বেশি দেওয়া যাচ্ছে। ফলে যাত্রীদের স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে।
নম্বর প্লেটের নামে চাঁদাবাজি
সিটি করপোরেশন থেকে রাজধানী ঢাকাতে রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স দেওয়া হয় না গত ৩৩ বছর ধরে। অথচ সংগঠন তৈরী করে রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স বা চুরি প্রতিরোধে পরিচয়পত্র (নম্বরপ্লেট) দেওয়ার নামে মালিকদের কাছ থেকে রীতিমতো চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। রাজধানীর প্রায় ১১ লাখ রিকশা-ভ্যান মালিকের কথিত পরিচয়পত্রের জন্য প্রতি বছর দিতে হচ্ছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
ঢাকা সিটি করপোরেশন সর্বশেষ কিছু রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স দিয়েছে ১৯৮৬ সালে। অর্থাৎ ৩৩ বছর ধরে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এই সুযোগে অবৈধভাবে টাকা নিয়ে রিকশার লাইসেন্স বা নম্বরপ্লেট দিচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। রিকশা-ভ্যানের মালিকরা জানান, সংগঠন থেকে নম্বরপ্লেট না নিয়ে রিকশা রাস্তায় নামানো অসম্ভব। এমনকি চুরি হওয়া রিকশাও ফিরে পাওয়া যায় না।
জানা গেছে, রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের অনুমোদনের বাইরে প্রায় ১১ লাখ রিকশা-ভ্যান চলছে এখন। বেশ কয়েকটি সংগঠন থেকে এসব রিকশা-ভ্যানকে রাস্তায় চলাচলের জন্য অবৈধভাবে লাইসেন্স দেওয়া হয়। লাইসেন্স হিসেবে দেওয়া নম্বরপ্লেটকেই এসব সংগঠনের ভাষায় বলা হয় ‘পরিচয়পত্র’। সিরিয়াল নম্বরও থাকে এপ্লেটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমপক্ষে ৩০টি সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব অবৈধ লাইসেন্স দেয়া হয়। তিন মাস মেয়াদে তৈরী করা একেকটি নম্বরপ্লেট ১৫০ থেকে ২শ’ টাকায় বিক্রি করা হয় মালিকদের কাছে। অবৈধভাবে লাইসেন্স দেওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ রিকশা মালিক লীগ, ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধা রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ও পরিবার পুনর্বাসন সোসাইটি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা রিকশা উন্নয়ন সোসাইটি এবং মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতিসহ আরও কয়েকটি সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন আজহার আলী, ইনসুর আলী, আবদুস সোবহান, কাসেম, হানিফ, শুকুর আলী, আমিনুর রশিদসহ শতাধিক ব্যক্তি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব সংগঠনের নেতারা রিকশায় চাঁদাবাজি করে মূলত নম্বরপ্লেট বিক্রি করে-যেটি ওই রিকশার চলাচলের অনুমোদন নিশ্চিত করে। রিকশার পেছনে লাগানোর জন্য দেওয়া এসব নম্বরপ্লেট তিন মাস ও ছয় মাস মেয়াদি। তিন মাস মেয়াদি নম্বর প্লেটের জন্য নেওয়া হয় ৫০-১৫০ টাকা। ছয় মাস মেয়াদি নম্বরপ্লেটের জন্য ২০০-৩০০ টাকা।
এছাড়া রিকশা-ভ্যান চুরি প্রতিরোধে ও চুরির পর রিকশা উদ্ধার এবং মালিকপক্ষকে সহায়তা করার নামে গঠিত দুটি সংগঠনের নেতারা রিকশায় আরও একটি পরিচয়পত্র বা নম্বরপ্লেট দিয়ে বছরে হাতিয়ে নিচ্ছেন কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের সংগঠন থেকে ৪৩ হাজার রিকশার নম্বরপ্লেট বিতরণ করা হয়। তিন মাস মেয়াদে বছরে চার বার ছাপানো হয় নম্বরপ্লেটগুলো। দুই/তিনগুণ ছাপানোর অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ১১টি ভূয়া সংগঠন রিকশার নম্বরপ্লেট ছাপে। তারা লাখ লাখ ছাপিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নম্বরপ্লেট বিক্রি করে এরকম কতোগুলো সংগঠন রয়েছে জানতে চাইলে রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে রয়েছে ২৫টি সংগঠন। বাকিগুলো সবই মুক্তিযোদ্ধা নামে। যেগুলো সত্যিকারের কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই।
প্রধান তিন সড়কে রিকশা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে ইনসুর আলী বলেন, সিটি কর্পোরেশনের নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। প্রধানমন্ত্রী রিকশা চলাচলের জন্য সড়কে লেন বানাতে বলেছেন। যতোদিন লেন তৈরী না হয় ততোদিন প্রধান সড়কে যাতে রিকশা চলতে পারে সেটাসহ ১১টি দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছি। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে আগামী ১৪ জুলাই দক্ষিণের মেয়রের সাথে মিটিং আছে।
গত ৩ জুলাই দক্ষিণ নগর ভবনে ডিটিসিবির সমন্বয় সভা শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন জানান, ৭ জুলাই থেকে রাজধানীর তিনটি প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল করবে না। রুটগুলো হচ্ছে কুড়িল-রামপুরা-সায়েদাবাদ, গাবতলী-আসাদগেট-আজিমপুর ও সায়েন্সল্যাব-শাহবাগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন