সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা কিংবদন্তীর এথলিট মোহাম্মদ আলী আর নেই। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে তিনি দুরারোগ্য পারকিনসন রোগে ভুগছিলেন। দু’দিন আগে তিনি শ্বাসকষ্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এরিজোনায় ফিনিক্স এরিনা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর গত শুক্রবার বিকেলে ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কেনটাকির লুইভিলে ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারী এক খ্রিস্টান দম্পতি ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে এবং ওডিসা গ্ল্যাডি ক্লে’র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা নিজের নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানের নাম রেখেছিলেন ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে জুনিয়র। ১৯৬০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রথমবারের মত বক্সিং-এ বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি সারাবিশ্বে চমক সৃষ্টি করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নের শিরোপা জিতে নিজেকে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ বলে দাবী করেন। তার এই দাবী সারাবিশ্ব মেনে নেয়। একই সাথে ক্যাসিয়াস ক্লে ‘নেশন অব ইসলাম’র সদস্য হিসেবে নিজেকে একজন মুসলমান বলে দাবী করেন এবং নাম পরিবর্তন করে প্রথমে ক্যাসিয়াস-এক্স রাখলেও এই নামটিকে দাসত্বের পরিচায়ক বলে মনে করে পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী রাখেন। ১৯৭৪ সালের বিশ্ব অলিম্পিকে তৃতীয়বারের মত হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ আলী সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম অঙ্কিত করেন। আজ পর্যন্ত কেউই এই রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।
মোহাম্মদ আলী শুধুমাত্র বিশ্ব শিরোপাধারী একজন মুষ্টিযোদ্ধাই ছিলেন না, তার নামের সাথে জড়িয়ে আছে সমকালীন বিশ্বরাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক সংগ্রামী ইতিহাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে তিন তিনবার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবময় ইতিহাস রচনার মধ্য দিয়ে তিনি যখন পশ্চিমা দুনিয়ায় গগনচুম্বি ও কিংবদন্তীতুল্য জনপ্রিয়তা স্পর্শ করেছেন, ঠিক তখন তার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করা ছিল এক অবিশ্বাস্য চমক। এটি তিনি চমক সৃষ্টির জন্য করেননি। করেছিলেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও ইসলামের শান্তি, সাম্য ও সৌহার্দ্যের নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভিয়েতনামযুদ্ধে যোগ দিতে তার অস্বীকৃতির মধ্য দিয়েই তার ন্যায়নিষ্ঠা, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও চারিত্র্যিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ৬১টি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ৫৬টিতে জিতে এক অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে পেশাদার মুষ্টিযুদ্ধ থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকেই তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার তথা দাওয়াতি ও দাতব্য কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ভিয়েতনামযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমবিদ্বেষী ও অভিবাসন বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলী সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।
বর্ণবৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিবাদী ও সংগ্রামী মোহাম্মদ আলীর জীবন বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর সাথে ছিল বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের এক নিবিড় আত্মিক বন্ধন। বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী সপরিবারে (বাবা, মা, ভাই, দ্বিতীয় স্ত্রী ও কন্যা লায়লা আলী) বাংলাদেশ সফরে আসেন মোহাম্মদ আলী। সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের পাহাড়, সুন্দরবনসহ নানাপ্রান্ত ঘুরে বেড়ান। তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘বেহেশত’ বলে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে বাংলাদেশের ‘সম্মানসূচক’ নাগরিকত্ব প্রদান করে বাংলাদেশের একটি পাসপোর্ট এবং নাগরিকত্ব সনদপত্র হস্তান্তর করেছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রদত্ত গণসম্বর্ধনায় মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, যদি কখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁকে সে দেশ থেকে বের করে দেয়, তবে তিনি বাংলাদেশে এসে বসবাস করবেন। বিংশতাব্দীর অন্যতম খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী মার্কিন নাগরিক মোহাম্মদ আলী আরো বহুদেশ থেকে বহু সম্মাননা ও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশকে তার ভাললাগা ও ভালবাসার স্বীকৃতি এ দেশের মানুষকে আপ্লুত করেছে। মোহাম্মদ আলী আমাদের ভাই। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের মানুষ একজন স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছে। আমরা মোহাম্মদ আলীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন