২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাজেটে ৭১ শতাংশই আসবে রাজস্ব খাত থেকে, এটা উচ্চাভিলাষী কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আমি নিজেই বলেছি, উচ্চাভিলাষী। তবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমি আত্মবিশ্বাসী।’ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বাজেট দিয়ে মধ্য আয়ের দেশ নয়, অগ্রগতি দিয়ে মধ্য আয়ের হওয়া সম্ভব। বিশ্বব্যাংক এটি নির্ধারণ করবে। জাতিসংঘ কমিটিও এটি জানাবে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থ বছরের জন্য ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী। প্রচলিত ধারা অনুযায়ী বাজেট নিয়ে সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষের অবস্থান পরস্পর বিপরীতমুখী থাকে। অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য থাকে। ইতোমধ্যে বাজেটের ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সরকারি দল স্বাভাবিকভাবেই বাজেটকে অতি উত্তম এবং জনমুখী বলেছেন। এ নিয়ে সরকারী দলের লোকেরা আনন্দ মিছিলও করেছে। অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলো এ বাজেটকে গণবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকগুলোর শিরোনামেও ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কোনো পত্রিকা শিরোনাম করে, আকাক্সক্ষা বিপুল সামর্থ্য কম, কোনোটি শিরোনাম করে চমক নেই নতুন বাজেটে, কোনোটি করে, আয় সন্ধানী বাজেট, কোনোটি করে, কর বাড়িয়ে সমৃদ্ধির স্বপ্ন। ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, বাজেট বাস্তবায়ন এবং অর্থায়ন দুর্বলতার কারণে শেষ পর্যন্ত আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
যে বাজেট ঘোষিত হয়েছে, আমাদের অর্থনীতি এবং বিপুল জনসংখ্যা বিবেচনায় তা খুব বেশি উচ্চাভিলাষী বলা যাবে না। তবে বাজেটের আকার বড় করে ঘোষণা করলেই হয় না, এর যথাযথ বাস্তবায়নই আসল কথা। বৃহৎ অংকের বাজেট ঘোষণা করে রাজনৈতিকভাবে বাহবা নেয়া যেতে পারে, বাস্তবায়ন করে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ পূরণ করতে না পারলে, তা এক সময় বিফল হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার তার রাজনৈতিক এজেন্ডার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এটা যেমন সরকারের একটি রাজনৈতিক দলিল, তেমনি অর্থনীতিরও একটি দলিল। এ দলিলের মধ্যেই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূত্র লিপিবদ্ধ থাকে। এতে ভাল এবং মন্দ দুটো দিকই থাকে। তবে বাজেট এমনভাবেই প্রণয়ন করা উচিত, যা পূরণ করা যায়। পুরোপুরি না হলেও যাতে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যাওয়া যায়। বলাবাহুল্য, বাজেটের অর্থ যোগানের মূল উৎস রাজস্ব খাত। জনগণের কাছ থেকে আদায়কৃত রাজস্বই এর প্রাণশক্তি। ফলে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলে জনগণের ওপর করের বোঝাও চাপে। এবারের বাজেটেও জনগণের ওপর করের বোঝা চেপেছে। এতে সন্দেহাতীতভাবে সাধারণ মানুষের টানাপড়েনের জীবনযাপনে আরও টান ধরবে। তারপরও জনগণ তা মেনে নিয়েই বাজেট বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের যে বিভিন্ন প্রশাসনিক যন্ত্র রয়েছে, সেগুলো তা বাস্তবায়নে কতটা সক্ষম? অতীতে আমরা দেখেছি, প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ পুরোপুরি সফল হয়নি। অর্থমন্ত্রী নিজেই এবারের সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছেন, গত বছর রাজস্ব আদায় নিম্নমানের হয়েছে। এবারের বাজেট এমন এক সময়ে ঘোষিত হয়েছে, যখন অর্থনীতিতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ পাইপ লাইনে জমা হয়ে থাকলেও তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ সহায়তা ব্যবহারের সক্ষমতাও প্রশাসন দেখাতে ব্যর্র্থ হয়েছে। অনেক উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহার করতে না পারায় ফেরত গিয়েছে। এডিপি কাটছাঁট করতে হয়েছে। যদিও সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের ধাক্কা এসেছে। ফলে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। এসবই আশাবাদের কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, বাজেট বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। এ কথা সবাই জানেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ না হওয়ার বড় একটি কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল বলে প্রতীয়মান হলেও বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে ভুগছেন। তাদের মনে এই শঙ্কা বিরাজ করছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সরকার দমন করে রাখতে পারলেও যে কোনো সময় তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এই আশঙ্কাই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে অনুৎসাহী করে তুলেছে। এছাড়া বিনিয়োগের জন্য যে উপযুক্ত অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তার অপ্রতুলতা রয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন ও লক্ষ্য অর্জন এবং বিনিয়োগকে উৎসাহী করে তুলতে সরকারকে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
আমাদের দেশে বাজেট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। এবারও বেড়েছে। বাজেট ঘোষণার পর বাস্তবায়নের আগে আরও একদফা বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারের তরফ থেকে এসব নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এবারের বাজেট বিগত বছরগুলোর মতোই গতানুগতিক। এতে কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট কোনো কথা বলা হয়নি। বিবিএসের হিসেবেই দেশে কর্মসংস্থান কমে গেছে। বাজেটেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এতে যে প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন কঠিন হবে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে প্রবৃদ্ধির চাকা কিছুটা সচল থাকলেও এ দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। তাই কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেয়া উচিত ছিল। বাজেটে শুল্ক ও করারোপ করলে কিছু জিনিসের দাম বাড়ে। আবার প্রত্যাহার করলে দাম কমে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে যে কৃষক ধান-চাল উৎপাদন করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারতেন না, তাদের জন্য একটি ভাল উদ্যোগ হচ্ছে আমদানিকৃত চালের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করা। এতে চাল আমদানি যেমন নিরুৎসাহিত হবে, তেমনি কৃষকরা লাভবান হবে। ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবী, বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া। বাজেটে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তার অর্থ এ সুযোগ থাকছে। এতে কিছুটা হলেও দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাজেট প্রণয়ন বড় কথা নয়, তা বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। যথাযথ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ওপর এর সাফল্য নির্ভর করে। যেসব খাতওয়ারি বাজেট করা হয়েছে, সেসব খাত সংশ্লিষ্টদের এ বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা ও দক্ষতা দেখাতে হবে। সঠিকভাবে যথাসময়ে তদারকির মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকা-কে এগিয়ে নিতে হবে। তা নাহলে বাজেট যত বড়ই হোক এবং যত উচ্চাকাক্সক্ষাই পোষণ করা হোক না কেন, তা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন