ব্যাপক প্রাণহানি, নজিরবিহীন সহিংসতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, দুষ্কৃতী, জালভোট, কেন্দ্র দখল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। ২২ মার্চ থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ৬ ধাপে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের শেষ ধাপেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক শ’। ২৮ মে পঞ্চম ধাপের ভোট গ্রহণের দিন আহত একজন গত ৪ মে মারা গেছে। এ পর্যন্ত এ নির্বাচনে সর্বমোট ১৩০ জন মারা গেছে, আহত হয়েছে অন্তত ১০ হাজার এবং পঙ্গু হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনে এত মানুষ হতাহত ও পঙ্গু হয়নি। শুধু তাই নয়, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস সম্পূর্ণ ওলট-পালট হয়ে গেছে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এই ক্ষতি মারাত্মক ও অপূরণীয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রতিটি ধাপের নির্বাচনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ দাবি করেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কেউ যদি অন্ধ না হয়, তার কান যদি বধির না হয়, বিবেক যদি বন্ধ্যা না হয়, লজ্জা-শরম যদি উধাও হয়ে না যায়, তাহলে তার পক্ষে এ রকম দাবি করা অসম্ভব। আসলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তার পারিষদবর্গ অন্ধ ও বধির হয়ে গেছেন। তাদের বিবেক অকার্যকর হয়ে গেছে এবং লজ্জা-শরম ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। এই প্রাণহানি, এই সন্ত্রাস-সহিংসতা, এই সামাজিক-আর্থিক ক্ষতির দায় নির্বাচন কমিশন কোনোমতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। কেউ এই নির্বাচনকে ‘ভোট ও গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক’ বলে অভিহিত করেছেন, কেউ একে ‘শহীদী নির্বাচন’ বলেছেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচনে মানুষ হত্যার বৈধতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ তো নির্বাচন নয়, হোলি উৎসব। এর দায় নির্বাচন কমিশনের।’
সঙ্গত ও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এ ধরনের নির্বাচনের আদৌ কি কোনো প্রয়োজন ছিল? যে নির্বাচনে এত মানুষের প্রাণ গেলো, এত মানুষ আহত ও পঙ্গু হলো, গ্রামীণ সমাজ ও জীবন এতটা বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সে নির্বাচন না করলে কি হতো? নির্বাচনে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। জনরায় প্রতিফলিত হতে দেয়া হয়নি কিংবা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি অনুসরিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, সরকারী দল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক জোট হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন হলে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারতেন এবং সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। জনপ্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমেই গ্রামীণ জনসমাজের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। ইউপি নির্বাচন এক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের কাছে যেমন এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও তা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ভয়াবহ প্রাণহানিকর এবং ক্ষতি ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নিষ্ফল এ নির্বাচনের কোনোই প্রয়োজন ছিল না। নির্বাচন কমিশন এরকম একটি নির্বাচন করে শুধু তার অদক্ষতা-অযোগ্যতারই প্রমাণ দেয়নি, তার দলবাজ ভূমিকারও পরিচয় দিয়েছে এবং দেশ-জাতির অপূরণযোগ্য ক্ষতিসাধন করেছে। এর দায় তাকে অবশ্যই বহন করতে হবে। কথায় বলে, ‘এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে।’ আজ হয়তো কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ ও তার পারিষদবর্গ জবাবদিহির সম্মুখীন হচ্ছেন না। তবে একদিন হয়তো তাদের জবাবদিহি করতে হবে, জনতা ও আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। দেশ ও জাতি কমিশনের কাছে বিশাল এক দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেয়াই ছিল তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সে পর্যায়ক্রমে এবং চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং তার অপ্রয়োজনীয়তা দেশে-বিদেশে উন্মোচিত করে দিয়েছে।
আজকে দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক দুর্ঘট তার জন্যও মূলত দায়ী নির্বাচন কমিশন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বাভাবিক চর্চা এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন এখন অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গেছে। এর মূলে রয়েছে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন। ওই নির্বাচন ছিল একতরফা। তার অংশগ্রহণমূলক বৈশিষ্ট্য ছিল না। তাছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ও ছিল না। নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য। এভাবে বিনা ভোটে কোনো দলের সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বিশ্বের নির্বাচনের ইতিহাসে ছিল নজিরবিহীন। ওই নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা না পেলেও নির্বাচন কমিশনের দাবি অনুযায়ী তা ছিল অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ। বস্তুত সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও অস্থিতিশীলতা স্থায়ী হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপাত স্থিতিশীল বলে মনে হলেও ভেতরে অসহিষ্ণুতা ও অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান। এ কারণেই দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রত্যাশা অনুযায়ী চাঙ্গা হচ্ছে না। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ আসছে না, শিল্পায়ন হচ্ছে না, কর্মসংস্থান বাড়ছে না। অন্যদিকে প্রবাসী আয় ও রফতানি আয়ও সেভাবে বাড়ছে না। পর্যবেক্ষকরা একমত, ২০১৪ সালের নির্বাচন যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হলে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমন নাজুক হয়ে পড়ত না। আইনশৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা, আইনের শাসন, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির এতটা অবনতি ঘটত না। এসবের জন্য অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে দায়ী হতে হবে। নির্বাচন কমিশন কখনোই তার অপারগতা স্বীকার করেনি, পদত্যাগ করে সরে যাওয়ার চিন্তা করেনি। অথচ অতীতে এরকম নজির রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি আবদুর রউফের পদত্যাগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি ন্যুব্জকুব্জ, আজ্ঞাবাহী কমিশন হিসেবে তার পরিচয় সুনির্দিষ্ট করেছে। ভবিষ্যতে এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা যে সম্ভব নয়, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের মানুষ এ ধরনের নির্বাচন কমিশন এবং প্রাণহানিকর অগ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন দেখতে চায় বলে মনে হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন