অত্যন্ত ধার্মিক, স্বহস্তে পবিত্র কুরআন শরীফের অনুলিপি তৈরি করে পবিত্র স্থানে বিতরণকারী হিসেবে বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন মুর্শিদকুলী খান। তিনি একাধিক মসজিদও তৈরি করেন। তিনি ঢাকার করতলব খান মসজিদ (বেগম বাজার মসজিদ) এবং মুর্শিদাবাদ মসজিদ নির্মাণ করেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত যতœবান। তিনি ছিলেন বাংলায় নওয়াবী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলায় মুর্শিদকুলী খানের কর্মজীবন শুরু হয় প্রাদেশিক দীউয়ান হিসেবে। একে একে বাংলা ও উড়িষ্যার নাজিম বা গভর্নর, বিহারের দীউয়ান এবং কয়েকটি জেলার ফৌজদারের পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অবসান হয়।
মুর্শিদকুলী খানের জন্ম, পরিবার ও পিতা-মাতা সম্পর্কে নিশ্চিত কোন কিছু জানা যায়নি। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ইস্পাহান শহরের পদস্থ মোগল কর্মকর্তা হাজী শফি তাঁকে ইরানে নিয়ে পিতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। হাজী শফি তাঁকে প্রয়োজনীয় সুশিক্ষাদান করেন। পালক পিতা হাজী শফি মৃত্যুবরণ করার পর মুর্শিদকুলী খান ভারতে এসে গোলকুন্ডার ফৌজদার ও দীউয়ান হিসেবে মোগল সরকারের চাকরিতে যোগদান করেন। একই সাথে তিনি ‘মনসবদারি’ লাভ করেন। তৎকালীন সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার প্রদেশের জন্য একজন সৎ, বিশ্বস্ত ও দক্ষ দীউয়ানের সন্ধান করছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব তরুণ মুর্শিদকুলী খানকে এ পদের জন্য যোগ্য মনে করে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সম্মানসূচক ‘করতলব খান’ উপাধি দিয়ে দীউয়ান হিসেবে বাংলায় নিয়োগ প্রদান করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে মুর্শিদকুলী খান (করতলব খান) ঢাকায় এসে রাজস্ব ও অর্থনৈতিক প্রশাসনে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে সম্রাটের আস্থাভাজনে পরিণত হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং সম্রাটের বিশ্বস্ত। কিন্তু রাজকীয় স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বাংলার নাজিম ও সম্রাটের দৌহিত্র আজিমুদ্দীনের সঙ্গে তাঁর চরম বিরোধ শুরু হয়। একপর্যায়ে তাঁর জীবন পড়ে হুমকির মুখে। তবে সম্রাটের হস্তক্ষেপে করতলব খান সুবিচার প্রাপ্ত হন। ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে গঙ্গার তীরবর্তী (ভাগীরথী শাখা) মকসুদাবাদে তাঁর দফতর স্থানান্তরের অনুমতি প্রদান করেন। অন্যদিকে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর দৌহিত্র আজিমুদ্দীনকে দ্রুত পাটনায় গমনের নির্দেশ প্রদান করেন। সম্রাট তাঁকে সেখানে নায়েবের মাধ্যমে প্রদেশ শাসনের আদেশ দেন। এদিকে করতলব খানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। যাতে সম্রাট অত্যন্ত খুশি হন। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে করতলব খান সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে দাক্ষিণাত্য যান। সাক্ষাতের সময় সম্রাট করতলব খানকে ‘মুর্শিদকুলী খান’ উপাধি প্রদান করেন। এভাবে তাঁর পদমর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নতুন উপাধি ও অন্যান্য মর্যাদাসহ দাক্ষিণাত্য থেকে ফেরার পর ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় কোম্পানির প্রতিনিধিগণ এবং হুগলির ফৌজদার তাঁর সঙ্গে কটক, মেদিনীপুর ও বর্ধমানে সাক্ষাৎ করেন। সম্রাট সে সময়ে মকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নতুন উপাধি অনুসারে মুর্শিদাবাদ রাখার অনুমতি প্রদান করেন। সে অনুমতি প্রাপ্তির পর মকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন হয়ে নতুন নামকরণ হয় মুর্শিদাবাদ। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন। এর পরপরই মোগল সাম্রাজ্যে চরম অস্থিরতা শুরু হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, যে কোন সময় মোগল সাম্রাজ্যের পতন হতে পারে। এ অবস্থায় অনুপস্থিত নাজিমের পক্ষে তাঁর প্রতিনিধি (নায়েব) বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে মুর্শিদকুলী খানকে দাক্ষিণাত্যে বদলি করা হয়। তবে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে আবারও মুর্শিদাবাদে ফেরত আনা হয়। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফররুখ সিয়ার-এর নাবালক পুত্র ফরখুন্দ সিয়ারের পক্ষে ডেপুটি সুবাহদার পদে নিযুক্ত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি অনুপস্থিত সুবাহদার মীরজুমলার ডেপুটি সুবাহদার হন। মীরজুমলা মুর্শিদাবাদে অবস্থান করতেন। মুর্শিদকুলী খান তখন ঢাকায় সর্বোচ্চ পদমর্যাদার অফিসার হওয়ায় প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তাঁর হাতেই ছিল। বাংলার জন্য এটা সৌভাগ্য যে, মুর্শিদকুলী খান এই প্রদেশকে সব রকমের বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান বাংলার নাজিম পদে উন্নীত হন। এ সময় তিনি অসংখ্য উপাধি ও পদবিতে ভূষিত হন। প্রথমে তিনি ‘জাফর খান’ উপাধি পান। পরে তিনি ‘মুতামিন-উল-মুলক আলা-উদ-দৌলা জাফর খান নাসিরী নাসির জঙ্গ বাহাদুর’ উপাধি পান। সম্রাটের পক্ষ থেকে তাঁকে সাত হাজারি মনসব প্রদান করা হয়। তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল তিনটি প্রদেশ। এই সুবাদে তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী টোডরমল ও শাহ সুজা প্রবর্তিত ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত পদ্ধতির সংস্কার করে একটি নতুন বন্দোবস্ত পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। রাজস্ব কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা নিশ্চিত করেন এবং এভাবে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেন। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থা ‘মাল জমিনী’ নামে পরিচিত। তাঁর আমলে বেশ কিছু নতুন ও বৃহৎ জমিদারির গোড়াপত্তন হয়। তাঁর সময়ে জমিদার হিসেবে সাধারণভাবে হিন্দুদেরই তিনি নিয়োগ করতেন। কারণ তিনি মনে করতেন হিন্দু জমিদারদের মাধ্যমে হিন্দুদের কাছ থেকে সহজে রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে।
মুর্শিদকুলী খানের আমলে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে বাংলার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আরব, পারস্য ও আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় সক্রিয়ভাবে বাণিজ্য শুরু করে। সতের শতক থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বাংলায় উৎপাদিত সুতা, রেশম এবং তা থেকে উৎপন্ন বস্ত্র ক্রয় করা শুরু করে। এসব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বাংলায় স্বর্ণ ও রৌপ্য আমদানি করত। এর ফলে এদেশে বাংলায় প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এই ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা ব্যবসায়ী, সাহু বা পোদ্দার, মহাজন, বানিয়া ও দালালরা অতিদ্রুত মহাজনি ব্যবসায় উন্নতি লাভ করে। এ ধরণের বহু মহাজনের মধ্যে ‘জগৎ শেঠ’ প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। মুর্শিদকুলী খান কোম্পানিগুলিকে সৎ ব্যবসায় উৎসাহ প্রদান করতেন। তিনি অসৎ ব্যবসায়ীদের কঠিন শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেন। মুর্শিদকুলী খান সম্রাটের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। সম্রাটের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষায় তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। এ কারণে তিনি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কলকাতার আশেপাশে বেশিগ্রাম ক্রয়ের অনুমতি দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এক পর্যায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজকীয় ফরমান জারি করে। তারপরও মুর্শিদকুলি খান ছিলেন অনমনীয়।
১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন মুর্শিদকুলি খান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের ইতি ঘটে। তাঁর অবর্তমানে উত্তরসূরী হিসেবে বাংলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুজা-উদ্দীন মুহাম্মদ খান।
ismail.press2019@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন