রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কোথাও নিরাপত্তা নেই

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৯, ১২:০০ এএম

কুমিল্লার আদালতে একটি হত্যা মামলায় হাজিরা দিতে এসে এক আসামির এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে একই মামলার অপর আসামি নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ দেখা গেছে।

সম্প্রতি কুমিল্লার অতিরিক্ত তৃতীয় দায়রা জজের উপস্থিতিতে, এজলাসেই এক আসামি আরেক আসামিকে ছুরি নিয়ে ধাওয়া করে বিচারকের খাস কামড়ায় ঢুকে ওই হত্যাকান্ড ঘটায়। এতে বিচারক ও আইনজীবীসহ উপস্থিতরা নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য বিচারক নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হন এবং হত্যাকারীকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন পুলিশের এক উপপরিদর্শক। ছুরিকাঘাতে আহত আসামি হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা যান। এই ঘটনায় আসামিদের প্রহরা দেওয়া এবং আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিচারক এবং আসামিদের নিরাপত্তা নিয়ে।

আদালতে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন উঠেছে, জামিনে থাকা একটি হত্যা মামলার আসামি কীভাবে তল্লাশি এড়িয়ে ছুরি নিয়ে বিচারকক্ষে প্রবেশ করলেন? নিয়মানুসারে হাজিরার সময়ে আদালতের এজলাস বা বিচারকক্ষে আসামিরা তাদের জন্য সুরক্ষিত নির্ধারিত প্রকোষ্ঠে থাকবেন এবং প্রয়োজনে প্রহরাধীন অবস্থায় কাঠগড়ায় উঠবেন। তাহলে, আসামি কী করে মুক্ত অবস্থায় ছুরি নিয়ে অপর আসামিকে ধাওয়া করলেন? এমনকি ধাওয়া খাওয়া অপর আসামি আত্মরক্ষায় এজলাসের পার্শ্ববর্তী বিচারকের খাস কামরায় আশ্রয় নিলে সেখানে গিয়েও তাকে ছুরিকাঘাত করতে সক্ষম হলেন হত্যাকারী? এই ঘটনায় আসামিদের প্রহরা এবং বিচারকক্ষে প্রবেশকালে তল্লাশির দায়িত্বে কোনো গাফিলতি হয়ে থাকলে দোষীদের চিহ্নিত করে যথার্থ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আদালতে হত্যাকান্ডের এমন নজির সাম্প্রতিককালে আর না থাকলেও আদালত থেকে আসামি পালানোর ঘটনা বিরল নয় মোটেই। বিগত বছরগুলোতে পুলিশের হেফাজতে আদালতে হাজির করা আসামি পালানোর বহু ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যা মামলার চার আসামি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে এসে জামিন বাতিলের পর কাঠগড়া থেকে পালিয়ে গেলে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শরীয়তপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত থেকে মাদক মামলার এক আসামি পালিয়ে যায়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আদালতের হাজতখানা থেকে এজলাসে নেওয়ার সময় হাতকড়া খুলে পালিয়ে যায় এক আসামি। একই বছরের জুলাইয়ে নেত্রকোনার আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের হেফাজত থেকে স্ত্রী হত্যা মামলার এক আসামি পালিয়ে যায়। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই পুলিশের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির অভিযোগ ওঠে এবং কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আদালত থেকে আসামি পালানো বন্ধ করা যায়নি।

এর আগে পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এটা হত্যা বা আত্মহত্যা যাই হোক না কেন তা অত্যান্ত দুঃখজনক। কারণ কারাগার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। অথচ সেখানে কেরোসিন বা পেট্রোল কীভাবে যেতে পারে, কীভাবে তা দিয়ে গায়ে আগুন দেওয়া সম্ভব তা তদন্তে বেরিয়ে আসা উচিৎ।

প্রসঙ্গত, আইনজীবী পলাশকে গত ২৬ এপ্রিল বিকেলে ঢাকা পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সকালে হঠাৎ হাসপাতালের বাইরে থাকা একটি টয়লেট থেকে সে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় দৌড়ে বের হয়। এ সময় কারারক্ষীরা তাকে উদ্ধার করে এবং শরীরের আগুন নেভান। তার শরীরের ৪৭ শতাংশ পুড়ে যায়। রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরদিনই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরে গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। বলা হয়ে থাকে কারাগার বন্দীদের আটক বা আবদ্ধ রাখার স্থান। এ ঘটনা প্রমান করে কারাগারে আসামীরা এখন কতটা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে?

কারাগারে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ কারাগারের স্লোগান হচ্ছে, ‘রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ’। নিরাপদ জায়গায় কীভাবে একজন মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় তা বোধগম্য নয়। প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, তবে কি কারাগারেও মানুষের নিরাপত্তা নেই। অপরাধী ও অপরাধপ্রবণদের ঠেকানোর কোনো উপায়ই নেই? আমরা মনে করি, আগুনে পুড়িয়ে অথবা অন্য কোনোভাবে সংঘটিত হত্যাকান্ডগুলোর প্রতিটিরই সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। এছাড়া মানুষের মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটছে দিন দিন, সে বিষয়টিও গভীরভাবে ভাবতে হবে। মূল্যবোধের সূচক কীভাবে উপরে তোলা যায়, সে ব্যাপারে মানুষের মনোচিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে।

কুমিল্লায় আদালতের এজলাসে বিচারকের সামনেই ছুরিকাঘাতে একজনের মৃত্যুর পর এবার হত্যা মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন নিতে আসা এক আসামি বাদীপক্ষের লোকজনের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুল আউয়াল মারামারি থামাতে গেলে তাকেও মারধর করা হয়। পরে আইনজীবীরা বাদীপক্ষের একজনকে আটক করেন। এদিকে টাঙ্গাইলে নিখোঁজের চারদিন পর ১৩ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে নদী থেকে মুক্তিযোদ্ধা আইনজীবী মিঞা মোহাম্মদ হাসান আলী রেজার (৭৬) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

সারা দেশের আদালত অঙ্গনে বিচারক, আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া কুমিল্লার আদালতের যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাও জানাতে বলা হয়েছে। বিচারকদের নিরাপত্তা চেয়ে করা রিটের শুনানি প্রাথমিক শুনানিকালে ১৭ জুলাই বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ মৌখিকভাবে এ নির্দেশ দেন।

কুমিল্লায় এজলাস কক্ষে বিচারকের সামনে আসামি হত্যা। টাঙ্গাইলে নিখোঁজের পর আইনজীবীর মৃত্যুদেহ নদী থেকে উদ্ধার, জেলখানায় আইনজীবীকে পুঁড়িয়ে হত্যার ঘটনায় একজন আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন। এ কারণে সমগ্র আদালত অঙ্গন ও বিচারকদের যথাযথ নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।


বিচারপ্রার্থী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি। একইসঙ্গে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, যে কোনো নাগরিক তা সে যে মামলার আসামিই হোক না কেন, পুলিশের হেফাজতেই হোক কিংবা প্রহরায়, আসামির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তাহীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, প্রেসিডেন্ট, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন