শৃঙ্খলা ফেরাতে ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের এক বছর অতিক্রান্ত হলেও আগের মতোই বিশৃঙ্খল রয়ে গেছে সড়ক-মহাসড়কে। আন্দোলনের পরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সড়ক সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে উঠেছিল। তারা তড়িঘড়ি করে নানা পদক্ষেপ নিলেও এত দিনেও সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। হাইকোর্টে জমা দেয়া বিআরটিএ’র এক প্রতিবেদনে বিশৃঙ্খলার এমন একটি চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যেও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলছে।
সড়ক সংশ্লিষ্টদের মতে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিআরটিএ’র অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও দালালদের দৌরাত্ম্য, পরিবহন সেক্টরের দুর্বৃত্তায়ন, বেপরোয়া চালকদের আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অভিযুক্ত চালক-মালিক ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের বিচার ও শাস্তি না হওয়া, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজের সমন্বয়হীনতা এবং ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের হাতে পরিবহন সেক্টর কুক্ষিগত থাকায় কোনোভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবহন সেক্টরের অনিয়ম আর দুর্বৃত্তায়ন বন্ধের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সচেতন করা গেলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীজুড়ে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। সে সময়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট। পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেই ছাত্র আন্দোলনের এক বছর পার হলেও ঢাকার সড়কে বিশৃঙ্খলা আগের মতোই রয়ে গেছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের একটা বড় দাবি ছিল, সড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন উচ্ছেদ করা। কিন্তু দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে চলাচলরত যানবাহনের ফিটনেসের করুণ অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। হাইকোর্টে জমা দেয়া বিআরটিএ’র একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে এখনো আনফিট মোটরযান আছে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার। এসব যানবাহনের বেশির ভাগই চলাচল করছে রাজধানীতে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশজুড়ে ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নবায়ন না করে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি যানবাহন রাস্তায় চলাচল করছে। এসব যানবাহনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২ লাখ ৬১ হাজার ১১৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৮৮, রাজশাহী বিভাগে ২৬ হাজার ২৪০, রংপুর বিভাগে ৬ হাজার ৫৬৮, খুলনা বিভাগে ১৫ হাজার ৬৬৮, সিলেট বিভাগে ৪৪ হাজার ৮০৫ এবং বরিশাল বিভাগে ৫ হাজার ৩৩৮টি গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসবিহীন রয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনের পর ঢাকায় বাস স্টপেজের জন্য ১২১টি স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। প্রথম কয়েক দিন এসব স্টপেজে বাস দাঁড়ালেও বর্তমানে বেশির ভাগ স্টপেজেই বাস থামছে না। একই অবস্থা চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা লাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও। বেশির ভাগ বাসই দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যদের ফাঁকি দিতে নামকাওয়াস্তে দরজা লাগানোর ভান করে চলে। ঢাকার বেশির ভাগ ফুটপাথ আগেও হকারদের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখনো তা-ই আছে। যে যার মতো যানবাহন পার্কিংও করছে। হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকার আন্ডারপাসগুলোয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি আয়না লাগানোরও নির্দেশ ছিল। গত বছরের ৩০ আগস্টের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বাস্তবে ঢাকার আন্ডারপাসগুলো ঘুরে সে রকম কিছু চোখে পড়েনি।
আন্দোলনের পর ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি প্রবর্তনে নড়েচড়ে বসে সরকার। ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো এসব সিগন্যাল বাতি যথাযথ ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়, যেগুলো এখনো জ্বলেনি।
এখনো ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে মানুষ। যাত্রীর জন্য বাসগুলোর প্রতিযোগিতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফুটপাথগুলো এক বছরেও পথচারীবান্ধব হয়নি। রাস্তার ওপর বন্ধ হয়নি পার্কিং। রঙ হারাতে শুরু করেছে এক বছর আগের জেব্রা ক্রসিং। গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হচ্ছে দড়ি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পরই সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস করে সরকার। তবে সে আইনটি প্রয়োগে সরকার গাফিলতি করছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী তড়িঘড়ি করে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস করা হলেও আজও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। চালক প্রশিক্ষণ, যানবাহনের ফিটনেস আধুনিকায়ন, রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ সিস্টেমে বাস চলাচল নিশ্চিত করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বন্ধ করা, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে সরকারের অঙ্গীকারও দৃশ্যমান নয়।
তবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক বছরে ঢাকাসহ দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা অনেকটাই বদলে গেছে। এ ক্ষেত্রে তারা উদাহরণ হিসেবে মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী- উভয়েরই হেলমেট ব্যবহার করার উদাহরণটাই বেশি দিচ্ছেন।
বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) তথ্যানুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে ১ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১ হাজার ৫৫২ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৩৯ জন আহত হন। জাতীয় মহাসড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কসহ সারাদেশে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এই সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, দৈনিক চুক্তিতে চালক, কন্ডাক্টর বা হেলপারের কাছে গাড়ি ভাড়া দেয়া, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, সড়কে চলাচলে পথচারীদের অসতর্কতাসহ ১০টি কারণ উলেখ করা হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের এক বছরে কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে। কিন্তু সেটা দৃশ্যমান নয়। পথচারী পারাপার, জেব্রা ক্রসিং, ফুট ওভারব্রিজ, আন্ডারপাসসহ এসব বিষয়ে সরকারের যে অঙ্গীকারগুলো ছিল, সেগুলো পূরণ হয়নি। কোনো কোনো জায়গায় উন্নয়ন কাজের জন্য কিছু ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। এসব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হলেও পথচারী চলাচলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাব মতে, গত এক বছরে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৩৮ শতাংশই পথচারী। ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ এই হিসাব দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু বিমানবন্দর সড়কে মারা গেছেন ৪৬ জন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্যাহ বলেন, নিরাপদ সড়কের আর সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়টা ভিন্যরকম। আমাদের জাতীয় ও সিটিভিত্তিক উদ্যোগ আছে। ঢাকায় রোড রেশনালাইজেশনের কাজ চলছে। এটা হলে ঢাকায় টোটাল শৃঙ্খলা আসবে। এই কাজ চলমান রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পথচারী ও চালকদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে এক বছরে অনেক কাজ করেছি। হেলমেট, দরজা বন্ধ করে গাড়ি চালানো, পরিবহন নেতা ও চালকদের নিয়ে সভা, তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছি। সার্বিকভাবে আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তার মতে, ঢাকা শহরে দিন দিন জনসংখ্যা ও গাড়ি বাড়ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে কার্যক্রম চলছে।
এ দিকে, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে বুয়েটের এআরআইয়ের পরিচালক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিদ্যমান গণপরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা দায়ী। গণপরিবহন কমলেও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাসের একাধিক রুট বিদ্যমান, যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। একইভাবে নিয়োগপত্র ছাড়াই দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে চালকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন