কেজি শ্রেণীতে পড়ুয়া আবিরের লেখাপড়ায় মনোযোগ একদম কমে গেছে। আগের টার্মগুলোতে ফলাফল ভাল থাকলেও এবার অনেকগুলো বিষয়ে ও কোন রকমে পাস করেছে। জোর করে পড়ালেও আগেরমত মনে রাখতে পারছে না বলে জানালেন ওর মা। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ ও শারীরিক পরীক্ষা করে দেখা গেল ও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ওর ঠোঁটে ও মুখের কয়েক স্থানে জ্বালাপোড়া সহ ঘা রয়েছে এবং এই ঘা কিছুইতেই একেবারে ভাল হচ্ছে না। কয়েকদিন পর পরই আবার তা ফিরে আসছে। কয়েকটি পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া গেল যে রাজিবের রক্তে আয়রণ (লোহা) কমে যাওয়ার কারণে এতসব বিপত্তি দেখা দিয়েছে। কয়েকমাস আয়রণ এবং খাবারের পরিবর্তনের মাধ্যমে ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
রক্ত শূন্যতা কি?
রক্তের লোহিত কণিকার আকার পবির্তন হয়ে গেলে বা বয়স ও লিংগভেদে তাতে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলেই রক্তশূন্যতা দেখা যায়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বয়সভেদে রক্ত শূন্যতা নির্ণয়ের যে পরিমাপ ঠিক করেছে তা হল, (১) ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সে ১১ গ্রাম/ডেসি লি: (২) ৫ বছর থেকে ১১ বছর বয়সে ১১.৫ গ্রাম/ডেসি লি: এবং (৩) ১২ বছরের উপর ১২ গ্রাম/ডেসি লি: এর কম হলেই তাকে রক্ত শূন্যতা বলছে।
বাচ্চাদের রক্তশূন্যতার কারণগুলি কি কি?
(১) পুষ্টিজনিত কারণ- খাবারের মধ্যে লৌহ, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন-সি, বি-৬ ইত্যাদি কম থাকলে রক্তশূন্যতা হয়।
(১) বাচ্চার খাবারে হজমের সমস্যা থাকলেও এটা হতে পারে
-৬ মাসের পর বাড়তি খাবার ঠিকমত শুরু না করে দীর্ঘদিন মায়ের বুকের দুধ খেলে।
-কম ওজন নিয়ে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করলে বা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাচ্চা জন্ম নিলেও বাচ্চাদের রক্তশূন্যতা হতে পারে।
(২) শরীর থেকে রক্ত পড়লে-নাভী থেকে, পেটের আলসার থেকে, পায়খানার রাস্তায় পলিপ থাকলে, পেটে কৃমি হলে, হিমোফিলিয়া জাতীয় রক্ত রোগ হলেও রক্তশূন্যতা রোগ হতে পারে।
(৩) রক্ত কণিকা ভেঙ্গে গেলে-লোহিত কণিকার কোন রোগ বা কোন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্তকণিকা ভেঙ্গে গেলেও রক্তশূন্যতা হয়।
(৪) রক্ত কণিকা তৈরিতে ব্যাঘাত হলে-শরীরে দীর্ঘদিন কোন ইনফেকশন থাকলে, লিভার বা কিডনী রোগ থাকলে বা হাড়ের মজ্জায় কোন সমস্যা হলেও রক্তশূন্যতা হতে পারে।
কোন কোন কারণে রক্তশূন্যতা বেশি হয়?
-উপরিউক্ত সবগুলো কারণে রক্তশূন্যতা হলেও খাদ্যে লৌহের পরিমাণ কম থাকা এবং কৃমিজনিত কারণে রক্তক্ষরণ হয়েই আমাদের দেশের বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তশূন্যতা রোগ হয়।
বাচ্চাদের মধ্যে রক্তশূন্যতার প্রকোপ-
বাচ্চাদের রক্তরোগের মধ্যে রক্তশূন্যতাই প্রধান সমস্যা। সারা বিশ্বে বাচ্চাদের মধ্যে এর হার ৩০% হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই হার ৭০%। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৫ বছরের নীচের বাংলাদেশী বাচ্চাদের মধ্যে রক্তশূন্যতার হার প্রায় ৫৩%। আর ২ বছরের নীচের বাচ্চাদের প্রায় ৭৮%।
* খাবারের মধ্যেই লৌহ থাকে- খাদ্যে ভাল লোহা পাওয়া যায় গোশত, মাছ, কলিজা ইত্যাদিতে। রক্তশূন্যতায় এই সব লৌহ শরীরে প্রবেশের হার ২০-২৫% পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর শাক-সবজি, সিম, চাল, গমের লৌহ শরীরে প্রবেশের হার বাড়ে ৫-১০%। আবার ভিটামিন-সি, প্রোটিন জাতীয় খাবারও এই লৌহের হজম বাড়তে পারে। অন্যদিকে চা, কফি, ডিমের ফসফেট বা পালং শাকের কিছু উপাদান লৌহের হজম কমিয়ে দেয়।
* শরীরের জন্য দরকারি লৌহের পরিমাণ- জন্মের সময় একজন বাচ্চার শরীরে মোট ১/২ গ্রাম লৌহ থাকে আর পূর্ণ বয়স্কের শরীরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ গ্রামে। তাই বাচ্চার শরীরে বাড়তি লৌহ সঞ্চয়ের জন্য প্রতিদিন অন্তত ১ মিলিগ্রাম লৌহ হজম বাড়াতে হবে। বাড়ন্ত বয়সে চাহিদার তুলনায় কম লৌহ শরীরে প্রবেশ করতে থাকলেই এক সময় রক্তশূন্যতা রোগ দেখা দেয়।
রক্তশূন্যতার লক্ষণ উপসর্গ কি হয়?
কিছু কিছু হয় রক্তশূন্যতার জন্য আবার কিছু হয় লৌহের ঘাটতির জন্য।
ক) রক্তশূন্যতার লক্ষণ-শরীর দুর্বল লাগা, পড়তে, কাজ করতে ভাল না লাগা। শ্বাস ছোট হয়ে আসা এবং খুব খারাপ অবস্থায় হার্ট ফেইল হয়ে মুখে, পায়ে পানিও চলে আসতে পারে।
খ) লৌহ ঘাটতির লক্ষণ-ঠোঁটে, মুখে জিহ্বায় গালে কিছুদিন পর পরই ঘা তৈরি হয়। জিহ্বার খসখসে ভাব চলে গিয়ে পিচ্ছিল হয়ে যায়। ঢোক গিলতে গেলে গলায় ব্যথা অনুভূত হয়। হাত-পায়ের নখ প্রথমে পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। পরে চামচের মত উল্টা দিকে বেঁকে উঠে।
-স্বাভাবিক খাবার রেখে বাচ্চারা মাটি, ছাই, কাদা রং ইত্যাদি অখাদ্য মুখে দেয় খুব সহসাই।
-পড়ালেখায় ভাল না লাগা, মনোযোগ কমে যাওয়া, স্কুলের পরীক্ষার ফল খারাপ হতে থাকাও এর লক্ষণ।
-এরা খুব সহজেই ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ঘুমে শ্বাস বন্ধ হওয়ার লক্ষণও কারও কারও মধ্যে দেখা যায়।
পরীক্ষা নিরিক্ষা যা করতে হয়-
-সম্পূর্ণ রক্তের গণনা এবং ফিল্ম দেখতে হয়।
-লোহিত কণিকার ইনডেক্স পর্যবেক্ষণ দরকার।
সিরামের আয়রণ ফেরিটিন, বাইন্ডিং ক্যাপসিটি ইত্যাদি দেখতে হয়।
উপরের পরীক্ষায় ফল অন্য কোন রোগের আভাস দিলে বা কারণ নিশ্চিতের জন্য কখনও কখনও হাড়ের মজ্জা পরীক্ষা, প্রস্রাব, পায়খানা, বুকের এক্সরে করতে হয়।
চিকিৎসা যা জানা প্রয়োজন-
লোহার ঘাটতিজনিত কারণে রক্তশূন্যতা চিকিৎসার যে জিনিসগুলো অনুসরণ করে আগাতে হবে তা হল-
(১) লোহার ঘাটতির যে কারণ তার চিকিৎসা করা,
(২) বাচ্চাকে সুষম খাবার দেয়া নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) বাচ্চাকে লৌহসমৃদ্ধ খাবার, সময়মত বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার শুরু করা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং প্রয়োজনে কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে।
(৪) প্রয়োজনমত লৌহ সরবরাহের ব্যবস্থা করা
মুখে খাওয়ার জন্য আয়রণ খাওয়া যায়।
মুখে নিতে না পারলে বা অন্য কোন রোগের সাথে রক্তশূন্যতা থাকলে শিরায়/মাংশে লোহার ওষুধ দিতে হয়।
মারাত্মক রক্তশূন্যতায় প্রথমে শিরায় অন্যের রক্ত ট্রান্সফিউসন করা হয়।
তিন-চার দিনের মধ্যে ফল পাওয়া শুরু হলেও লৌহের ঘাটতি মিটিয়ে শরীরে আবার স্টোর তৈরি করতে কমপক্ষে ৩ মাস সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।
চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম : বাংলাদেশ সরকার জনগণকে সচেতন করার জন্য এবং চিকিৎসা হিসাবেও চালিয়ে যাচ্ছে দেশব্যাপী পুষ্টি কার্যক্রম। আবার সময়ে সময়ে ইপিআই এবং স্কুল হেলথের মাধ্যমে বাচ্চাদের মধ্যে কৃমির ওষুধ সরবরাহ করছে। তাই রক্তশূন্যতা হওয়ার আগে তা দূর করার প্রথম উদ্যোগই চাই সুষম খাদ্য সরবরাহ। কম ওজনের বাচ্চা বা সময়ের আগে জন্ম নেয়া অপুষ্ট বাচ্চার জন্য বিশেষ ডাক্তারি পরামর্শ প্রয়োজন। কম লৌহসমৃদ্ধ গরুর দুধের উপর বাচ্চাকে কখনওই নির্ভরশীল করবেন না। ৬ মাসের পরই বাচ্চাকে বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার শুরু করুণ। দীর্ঘ মেয়াদি কোন রোগ থাকলে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শমত তার চিকিৎসা নিন।
সমাজের এবং পরিবারের সচেতনতাই উপহার দিতে পারে রক্তশূন্যতাহীন সুস্থ ও মেধাবী শিশু।
ডা. জহুরুল হক সাগর
নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ
প্রাইম এইড হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার
শনির আখড়া বাসষ্ট্যান্ড, ব্যাংক এশিয়া ভবন
ফোন ঃ ০১৭১৬৮৬৫৩৫৪: ৭৫৪৪৪৪১
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন