রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। পরিস্থিতি ক্রমে ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতর হয়ে উঠছে। দেশের সরকারি বেসকারি হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তবুও স্রোতের মতো হাসপাতালগুলোতে রোগী আসা অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অর্ধশতের বেশি মানুষ মারা গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের ৮০ ভাগেরও বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত।
গত বুধবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিক্যালে অবস্থানকালে ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন এই প্রতিবেদক। দেখা
গেছে, হাসপাতালের নথিতে একটি রোগীর রেজিস্ট্রেশন শেষ না হতেই ভেতরে ঢুকছেন আরেকজন রোগী। প্রতিটি বেডে একজনের জায়গায় আগে থেকেই তিনজন করে রোগীতে পূর্ণ। এর বাইরে বারান্দাসহ হাসপাতালের মেঝের প্রতিটি কানায় রোগী দিয়ে পূর্ণ ছিল।
হাসপাতালের গেট থেকেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার প্রস্তুতি চোখে পরে। একটি রোগী আসা মাত্রই নিয়ে যাওয়া জরুরী বিভাগে থাকা চিকিৎসকের কাছে। পরে ট্রলিতে করে দ্রæত তাকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। চলাচলের রাস্তায় রোগী থাকায় ট্রলি বা হুইলচেয়ার চলতেও অনেক বেগ পেতে হয়। বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত হাসপাতালের পুরনো ভবনের ২০৮ নম্বর ওয়ার্ড শুধুমাত্র জ্বরে আক্রান্ত শিশু রোগীদের ভর্তির জন্য নির্দিষ্ট ছিল।
সংশ্লিষ্ট শিশু ওয়ার্ডটিতে দেখা গেছে, প্রতিটি একজনের বেডে তিনজন করে শিশু রাখা হয়েছে। এর বাইরে বেডের পাশের ফাঁকা জায়গা এবং চলাচলের পথেও পাটি বিছিয়ে রাখা হয়েছে জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের। এসব শিশুদের সাথে মা ছাড়া আরও কয়েকজন স্বজন এসেছেন দেখাশুনা ও ওষুধপত্র আনতে সহযোগিতার জন্য। কিন্তু মা অথবা একজন স্বজন ছাড়া অন্যদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। রোগীর সাথে অবস্থান করার মতো তিল পরিমাণ জায়গা না থাকায় কর্তৃপক্ষের এমন বারণ ছিল। স্বজনদের সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে বা হাটাহাটি করে নির্ঘুম রাত পার করতে হয়েছে।
এদিকে, পুরো ওয়ার্ডের ভেতরে ছিল ভ্যাপসা গরম। পুরনো আমলের ফ্যানগুলো কোনভাবে ঘুরলেও তাতে স্বস্থি ছিল না মোটেও। রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত চাপে ভেতরে অবস্থান করা দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। অসহনীয় গরমে সবার কপাল ও শরীর থেকে গাম ঝড়ছিল। ডেঙ্গু আক্রান্ত ছোট্ট শিশুরা থেমে থেমে চিৎকার করতে থাকে। হাত পাখা দিয়ে বাতাশ করলে কিছুটা থামলেও পাখার বাতাশ হতইে আবারও চিৎকার শুরু করে এসব শিশুরা। মায়েদের একার পক্ষে তাদের সামলানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
স্যালাইন লাগানোর প্রতিটি স্ট্যান্ডও ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছে কয়েকজনকে। প্রতিটি স্ট্যান্ডে কয়েকজন রোগীর স্যালাইনের বোতল ও তরল ওষুধ ঝোলানো ছিল। নাড়া লেগে একটু এদিক-ওদিক হলেও স্যালাইনের পাইপ বেয়ে রক্ত ওপরে উঠে যেতে দেখা গেছে। ব্যাথায় কাতর সেসব শিশুদের চিৎকার যেন সহ্য করার মতো না। ডেঙ্গু আক্রান্ত কম বয়েসী শিশুদের অবস্থা ছিল আরও নাজুক। তাদেরকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নাক দিয়ে গ্যাস দিতে হয়। এসব শিশুদের নাকে গ্যাস দিতে গিয়ে সব থেকে বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়েছে মায়েদের। গ্যাস দেওয়ার পয়েন্ট ছিল খুবই সীমিত। সেই তুলনায় ওয়ার্ডে থাকা শিশুদের সংখ্যা ছিল কয়েকগুন বেশি। যার কারণে সেখানেও ছিল মায়েদের সিরিয়াল। পর্যায়ক্রমে একজনের পর আরেকজন মা সন্তানের নাকে গ্যাস দেন। বেশিরভাগ মা সারারাত সন্তান কোলে নিয়ে একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বেশ কয়েকজন স্বজনকে আগে গ্যাস দেওয়া ও সিটে শোওয়ানো নিয়ে ঝগড়া করতে দেখা গেছে।
চিকিৎসক ও নার্সদের অবস্থাও ছিল অসহায়ের মতো। একজনের পেসক্রিপশন লেখা শেষ না হতেই অন্য একজন নতুন রোগী ভেতরে ঢুকছে। তাড়াহুড়ো করে একজনেরটা শেষ করে অন্যজনের ব্যবস্থাপত্রে হাত দিতে হয়। তাদের চেহারায় এক নাগারে টানা ডিউটি করার ছাপ স্পষ্ট ছিল।
দেখা গেছে, নতুন রোগী আসা মাত্রই তাদেরক ব্যবস্থাপত্র দেওয়া ছাড়াও শরীর থেকে রক্তের বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষা ও স্যালাইন দিতে হয়। সেসব নমুনা পরীক্ষার কাগজ নিয়ে সেই গভীর রাতেই ছুটতে হয় হাসপাতালের নতুন ভবনের প্যাথলজি বিভাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর মেলে এসব টেস্টের রেজাল্ট। গভীর রাতেই ল্যাবের কাছে ভীড় চোখে পড়ে। তবে তা দিনের উপচে ভীড়ের চেয়ে কিছুটা কম ছিল।
রক্তের নমুনা সংগ্রহের সময় প্রতিটি অবুঝ শিশুর চিৎকার আর আর্তনাদ হাসপাতালে আসা সব স্বজনদেরই কাঁদিয়েছে। অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এত রোগীদের সামাল দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্কটও স্পষ্ট বোঝা গেছে। ৫/৬ জন চিকিকৎসক ও নার্সের পক্ষে একটি ওয়ার্ড সামলানো ছিল অনেক কঠিন। পা সরালেই রোগীদের গায়ে লাগার আশঙ্কায় চিকিৎসকদেরও নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়েছে। এদিকে, রাত শেষে সকালের আলো ফুটলে শুরু হয় আরেক ঝামেলা। দিনের বেলা ওয়ার্ডের ভেতরে মেঝেতে কোন রোগী রাখার নিয়ম না থাকায় সবাইকে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। তখন ছোট্ট শিশুদের রাখা নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েন স্বজনরা। এক একটি বেডে তিন চারজন করে শিশুকে রেখে বিষয়টির সুরাহা করতে দেখা গেছে। তবুও দিন শেষে জ্বর বা ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানদের ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করতে করে আনন্দের ছাপ ছিল স্বজনদের চোখে মুখে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন