টার্গেট কিলিং প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। গতকাল মঙ্গলবারও ঝিনাইদহের একগ্রামে এক পুরোহিতকে হত্যা করেছে দুর্বৃৃত্তরা। এর আগে গত সোমবার চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের স্ত্রী ও নাটোরে এক খ্রিস্টান ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ১৮ মাসে এ ধরনের হামলায় লেখক, ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক ও পুলিশ সদস্যসহ খুন হয়েছে ৪৭ জন। চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী’র উপর হামলা এ ধরনের কোন প্রথম ঘটনা হলেও এর আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ৬৬টি হামলা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে , ২০০৫ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭৯ টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৬২টি। বিচারাধীন রয়েছে ৫৭টি ও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে ২৬০টি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, এসব টার্গেট কিলিং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তার মতে, এসব হত্যাকা- সংঘটিত করছে জঙ্গীরা। সৎ ও সাহসী পুলিশ অফিসারদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য বাবুল আক্তারের স্ত্রী’র ওপর বর্বর কাপুরুষোচিত হামলা চালানো হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মন্তব্য উদ্ধৃত করে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, আলোচ্য হত্যাকা- নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে আসছে না তেমন কোন ইতিবাচক ফল। যার কারণেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রায় নির্বিঘেœ একের পর এক হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গীরা। বিশ্লেষকরা এও মনে করেন যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতার অভাবের কারণেই জঙ্গী দমনে গৃহীত পদক্ষেপে কার্যকরী ফল আসছে না। সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ,দক্ষতা ও নিষ্ঠার অভাব রয়েছে।
টার্গেট কিলিংয়ের লক্ষ্য কি এবং এর সাথে কারা যুক্ত তা নিয়ে মতপার্থক্য যতই থাকুক একথা স্বীকার করতেই হবে, হত্যা অব্যাহত রয়েছে এবং তা ঠেকানো যাচ্ছে না। বিষয়টি এখন পর্যন্ত যেভাবে দেখা হচ্ছে তা যে যথেষ্ট নয় সেটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতালীয় নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যাকা-ের পর থেকে এ ধরনের হত্যাকা- নতুন মোড় নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আইএস দায় স্বীকার করছে বলেও বলা হচ্ছে। আবার সরকারের বিভিন্ন মহল থেকেও এর নানামুখী ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে। মিডিয়াতেও নানা ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। এর সাথে কারা জড়িত তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতও রয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশিদ মনে করেন জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমাদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যে কৌশল অনুসরণ করছে তা ফলদায়ক নয়। এটি কাজে দিচ্ছে না। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর পরিধি বাড়িয়ে উগ্রপন্থীদের অপতৎপরতা বন্ধ করা যাবে না। জঙ্গী বিরোধী কাজে অনেক ধরনের কৌশল রয়েছে সে সব কৌশলে এ ধরনের গুপ্তহত্যা বা টার্গেট কিলিং বন্ধ করতে সমর্থ হওয়া যায়। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াৎ হোসেন মনে করেন, জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পলিটিক্যাল যে দিক নির্দেশনা প্রয়োজন সেটিও হচ্ছে না। তার মতে, এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের রাজনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাও জরুরি। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেও একথা যথার্থই প্রতীয়মান হবে যে, মানুষ হত্যা যেন এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যখন তখন যেখানে সেখানে মানুষ হত্যা করতে কোন অসুবিধা নেই। দেশের সর্বশেষ অবস্থার চিত্র ফুটে ওঠেছে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনে। এই নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৩৫ জন। আহত হয়েছেন ১০ হাজার। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তিন হাজার। সংশ্লিষ্টরাই বলছেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের প্রতি শেষ আস্থাটুকুরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সহিংসতা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার ফলে কত বড় ক্ষতি হয়েছে তার পুরোটা বুঝতে হয়ত আরো কিছুটা সময় লাগবে, তবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় দেশে যা চলছে তাকে উস্কে দিতে রাজনৈতিক হঠকারিতাও কম দায়ী নয়। দেশে যে রাজনৈতিক স্থিতি ও স্বাভাবিকত্ব নেই সেকথা আরেকবার প্রমাণ করছে আলোচ্য হত্যা ঘটনাবলী। যারা বলছেন, স্থিতিশীলতা নষ্টের জন্য এসব করা হচ্ছে তাদের সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হবে। এসব ঘটনার সাথে জড়িত হিসেবে দেশী-বিদেশী যাদের কথাই বলা হোক না কেন মূল বিষয় হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সূত্র ধরে এবং একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিকে অগ্রাহ্য করতে গিয়ে গত কয়েক বছরে দেশে যা ঘটেছে এবং ঘটছে তাকে কোন বিবেচনাতেই রাজনীতির স্বাভাবিক গতি বলা যাবে না। রাজনীতিই দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সংগতভাবেই দেশের মানুষ রাজনীতিতে সন্তুষ্ট না থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব নানাভাবে পড়বে এবং স্বার্থান্বেষীরা সে অবস্থাটিকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আজকের দিনে সে ভাবনাই জরুরি।
চট্টগ্রামের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর বিদেশী গণমাধ্যমেও পুলিশ বাহিনীর পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় যে উৎকণ্ঠিত রয়েছেন সেটাও বোঝা যায়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) সাখাওয়াৎ হোসেন সংগত বিবেচনা থেকেই মনে করেন, আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশল বলে কিছু নেই। তারা হাজারে হাজারে রিক্রুট হচ্ছে অথচ তাদের ট্রেনিং বলেতো কিছু নেই। পুলিশের ট্রেনিং হচ্ছে চোর-ডাকাত ধরা। উগ্রবাদীদের মতো প্রশিক্ষিত ও সংঘটিত গ্রুপকে ধরার প্রয়েজনীয় ট্রেনিং তারা পায়না। তিনি পুলিশ বা এ ধরনের ফোর্সে মটিভেশনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, পুলিশ এখন মূল কাজের বাইরে অনেক কাজ করছে। র্যাঙ্ক এন্ড ফাইলে এফিসিয়েন্সির মধ্যে যথেষ্ট তফাত আছে। বাবুল আক্তার যে কাজটি করেছেন সেটি করা উচিত ছিল ওসির। এখন ওসির কাজ করেন এসপি, এসপি’র কাজ করছেন ডিআইজি আর ডিআইজি’র কাজ করছেন আইজি। যে স্তরের যে কাজ করার কথা সেটি হচ্ছে না। বাস্তবতই সামগ্রিক বিবেচনায় এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে যে পরিস্থিতি সামগ্রিক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে মূলত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে। সে কারণেই পরিস্থিতির কার্যকর উন্নতি চাইলে সুবিবেচনাপ্রসূত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সময়ের দাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন