একটু সচ্ছল জীবনযাপনের আশায় কত মানুষই পাড়ি জমান দেশের বাইরে। অনেকের জীবনে সেই সুখ আর ধরা দেয় না, বরং তা পরিণত হয় বিষাদে। তেমনই একজন খুলনার মেয়ে আবিরুন বেগম (৪৮)। মাত্র এক বছরের সংসার কাটানোর পর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তার। সেভাবেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি ১৮টি বছর। কিন্তু ছয় বোনের সংসার ও বৃদ্ধ বাবাকে দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। একটু সচ্ছলতার আশায় চলে যান সউদীতে। কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে ফিরছে তার লাশ।
রিক্রুটিং এজেন্সির দাবি করেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে আবিরুনের। তবে ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ড জানিয়েছে, সেখানে খুন করা হয়েছে তাকে।
আবিরুনের বিদেশ যাওয়ার নথিপত্র থেকে জানা যায়, তিনি রিক্রুটিং এজেন্সি ফাতেমা এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেসের (আরএল-১৩২১) মাধ্যমে সৌদি যান। ওই এজেন্সির কর্ণধার জাহিদুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘বাংলাদেশে থাকলেও আমরা মারা যেতে পারি। বিমানে বসেও মারা যাওয়া সম্ভব। আল্লাহ জানেন, কীভাবে মারা যায়। আল্লাহই জানে কে কীভাবে মারা যাবে। এক কাঠি কখনো বাজে না। একটা ঢোল আর একটা কাঠি দুই জায়গায় রাখলে বাজে না। একজন মরলে তাকে ধরে রাখা যায় না।’
আবিরুনের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, যাওয়ার কিছুদিন আগে হঠাৎ কি যেন ভেবে সউদী যাবার সিদ্ধান্ত আবার বাতিলও করেন। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সি এবং দালাল রবিউল ও নিপুণের চাপ ও হুমকির মুখে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সউদী যেতে বাধ্য হন আবিরুন।
আবিরুন দুই বছর সউদীতে থাকলেও টাকা পাঠানোতো দূরের কথা, বাড়িতে যোগাযোগও করতে পারেননি। দু’বছর পর তার পরিবারের কাছে খবর আসে মৃত্যুর। আবিরুনের পরিবার এখন তার লাশ পাওয়ার অপেক্ষায়।
আবিরুনের পরিবার জানায়, দু’বছরের মধ্যে কোনো টাকা পাঠাননি আবিরুন। যে দালালের মাধ্যমে তিনি সউদী যান, সেই রবিউল স্থানীয় ব্যক্তি। তাকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘অ্যাকাউন্ট নম্বরে ভুল আছে। আবিরুন ভালো আছেন।’
আবিরুনের বোন রেশমা আক্তার বলেন, ‘আমার বোনই আমাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। অথচ সৌদি যাওয়ার পরে আপার কোনো যোগাযোগ নেই। দালালের কাছে অনেক অনুরোধের পরে কয়েক মাস পর পর দু-এক মিনিট কথা বলতে পারতাম। ওখানে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছিল।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু কি করার ছিল। মামলা-মোকদ্দমা করলে আপার আরও ক্ষতি হবে বলে হুমকি দিত দালাল। টাকা-পয়সা না পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে দালাল বলত, তোমাদের দেয়া অ্যাকাউন্ট নম্বরে ভুল আছে। তাই টাকা আসে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক মাস আগে রবিউল জানান, আপা ঢাকায় টাকা পাঠিয়েছে, সেই টাকা আনতে তার সঙ্গে ঢাকা যেতে হবে। কিন্তু তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ায় আমরা কেউ যাইনি। ফিরে এসে তিনি ১৬ হাজার টাকা দিতে চান। কিন্তু দুই বছর পরে আপা মাত্র ১৬ হাজার টাকা পাঠাবে না, বিশ্বাস ছিল। তাই ওই টাকা আমরা নিইনি। তার কিছুদিন পরে জানলাম আমার বোন আর বেঁচে নেই। দালাল ও এজেন্সি বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে বলা হয়েছে, তিনি খুন হয়েছেন।’
রেশমা বলেন, ‘দালাল রবিউল আমাদেরকে হুমকি দিচ্ছে যে, এই বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে লাশ আনতে পারব না।’
রেশমার স্বামী আইয়ুব আলী বলেন, ‘আবিরুনের মৃত্যুর ৫১ দিন পরে সউদীতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ড মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি মারা গেছেন।‘
আবিরুনের মৃতদেহ সউদী আরবের একটি হাসপাতালে রাখা আছে। পরিবারের দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন তার মৃতদেহ দেশে আনা হয় এবং এই মৃত্যুর ন্যায়বিচার তারা পান। দুই বছর কোনো টাকা না পাওয়া বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক বলেন, ‘দুই বছর তার পরিবার কেন চুপ করেছিল। তারা কেন অভিযোগ করেনি। এর মানে তারা মিথ্যা বলছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ১২০ জন নারী কর্মী পাঠিয়েছি। বাকিদের অন্যরা এনেছে আমি প্রসেস করেছি। আবিরুনের পাসপোর্ট নম্বর জানার পরে বলতে পারব, তিনি কীভাবে সউদী যান।’
জাহিদুল আরও দাবি করেছেন, তার পাঠানো কোনো কর্মী ভালো নেই সেটা তাকে জানালে ৩-১৫ দিনের মধ্যে চাকরি পরিবর্তন করে দেন আবিরুন। তিনি বলেন, ‘আমরাও মানবতার বাইরে না। আমরাই কর্মীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করি।’
অবশ্য পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এজেন্সির অফিসে একাধিকবার তারা গেলেও কোন ফল হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন