রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ঝুঁকিপূর্ণ রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

রাজধানীর নিত্যদিনের যানজট তীব্র আকার ধারণ করায় মানুষের কর্মচাঞ্চল্য যে স্থবির হয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কর্মমুখর মানুষ সময়মতো এবং দ্রুত কর্মস্থলে পৌঁছার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করেন। এক্ষেত্রে মোটর সাইকেল বেশ কার্যকর। এই কার্যকারিতাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস। রাজধানীতে প্রায় এক ডজনের বেশি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের শত শত মোটর সাইকেল চলাচল করছে। এসব মোটর সাইকেলের বেশিরভাগ চালকই রাজধানীর বাইরে থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা এবং গ্রাম থেকে আসা তরুণ শ্রেণী। সমস্যা হচ্ছে, রাইড শেয়ারিংয়ের এসব চালকের বেশিরভাগই ট্র্যাফিক শৃঙ্খলা মানছে না। সিগন্যাল অমান্য, সড়কের বিভিন্ন ফাঁকফোকর এমনকি ফুটপাত দিয়ে তারা মোটর সাইকেল চালিয়ে দিচ্ছে। অনেক সময় হুট করে প্রাইভেট কিংবা বড় যানবাহনের সামনে চলে আসছে। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা যেমন ঘটে তেমনি আশঙ্কাও থাকে। তাদের এমন বেপরোয়া মনোভাবের কারণে একদিকে যেমন দুর্ঘটনা বাড়ছে, তেমনি অন্যান্য গতিশীল যানবাহনের চলাচলও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু হওয়ায় রাজধানীতে দিনে দিনে মোটর সাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাজধানীতে চলাচল করছে ৭ লাখের মতো। এ সংখ্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে দিনে প্রায় আড়াইশ’র বেশি। মোটর বাইকের এই সংখ্যা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে রাজধানীরচিত্র কী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ মোটর সাইকেলে দুর্ঘটনার হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর রাজধানীতে ৬৯টি মোটর সাইকের দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয় পঞ্চাশের অধিক। মোটর সাইকেলের এই বিশৃঙ্খলা এবং চালকদের বেপরোয়া চলাচল যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে দুর্ঘটনার হার ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

বিশ্বব্যাপী রাইড শেয়ারিংয়ের ধারণাটি বাণিজ্যিক নয়, অনেকটা সৌজন্যমূলক। কারো ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটর সাইকেল থাকলে তারা শখের বশে রাইড শেয়ারিং করে থাকে। আমাদের দেশে একেবারে কোম্পানি খুলে তাকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়া হয়েছে। এই বাণিজ্যিক রূপ দেয়াতে বেশি আয় এবং কর্মসংস্থানের জন্য দেশের দূর-দূরান্ত থেকে তরুণ শ্রেণী রাজধানীতে ছুটে আসছে। এদের বেশিরভাগই রাজধানীর সড়ক শৃঙ্খলা এবং অনেক এলাকা অজানা থাকে। এরা বুঝতে চায় না, মফস্বল বা জেলা শহরে মোটর সাইকেল চালানো আর রাজধানীতে চালানো এক কথা নয়। এই অজ্ঞতার কারণে তারা যেমন খুশি তেমনভাবে মোটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীতে চলাচলের ক্ষেত্রে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো এসব চালকেদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় বলে মনে হয় না। যদি সংশ্লিষ্ট রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অন্তর্ভুক্ত চালকদের যথাযথ ড্রাইভিংয়ের মানসিকতা এবং সড়কের শৃঙ্খলা সম্পর্কে গ্রুমিংয়ের ব্যবস্থা করত তাহলে তাদের বেপরোয়া মনোভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। অস্বীকার করার উপায় নেই, রাজধানীর তীব্র যানজটের কারণে অনেকে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য রাইড শেয়ারিং করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। রাজধানীতে কত সংখ্যক মোটর সাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহন চলবে, এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। এমনকি রাজধানীতে কত সংখ্যক লোক বসবাস করবে তার হিসাবও রাখা দরকার। অর্থাৎ রাজধানীকে যান ও জন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা এখন সময়ের দাবী। একেবারে গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা কাম্য নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই রাজধানীর জনসংখ্যা ও যানবাহন কত হবে তার হিসাব-নিকাষ থাকে। ভবিষ্যতে কত হবে তার আগাম হিসাব করে। লন্ডনে এই হিসাব নিয়মিত করা হয়। আমাদের রাজধানীর ক্ষেত্রে এখন এ হিসাব করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পুরো দেশের মানুষের লক্ষ্যই যদি রাজধানীমুখী হয় তবে রাজধানী আর রাজধানীর চরিত্র বজায় রাখতে পারে না। এই যে রাজধানীতে রাইড শেয়ারিংয়ের নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে, এর কারণটিও খুঁজতে হবে। আমরা কথায় কথায় রকেট গতির উন্নয়নের কথা বলছি। জিডিপির বৃদ্ধি নিয়ে গর্ব করছি। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এই বেকার তরুণদেরই একটি অংশ রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের জন্য রাজধানীতে ছুটে আসছে। তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের জন্য এ পথে ছুটছে এবং বেপরোয়া গতির হয়ে উঠেছে। আমরা এর আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণ যুবকদের সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়ার পথে সলিল সমাধি হতে দেখেছি। এর পেছনের কারণটিও ঐ বেকারত্ব। বেকারত্ব ঘুচাতে জীবনবাজি রেখে বিদেশ যাওয়ার জন্য বিপদসংকুল পথে তারা পা বাড়ায়। অন্যদিকে একই কারণে গ্রাম কিংবা জেলা শহরের বেকার তরুণরা রাইড শেয়ারিংয়ের পেশা বেছে নেয়ার জন্য রাজধানীমুখী হয়। সমুদ্রপাড়ি কিংবা রাইড শেয়ারিং এই দুই পথই ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানীতে মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ারিং যেভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা যদি এখন থেকেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে একসময় রিকসার মতোই রাজধানী মোটর সাইকেলের রাজধানীতে পরিণত হবে। এখন যেমন রিকসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, একই ব্যাপার ঘটবে মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে। কাজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মোটর সাইকেলের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজধানীতে কত সংখ্যক মোটর সাইকেল চলবে তার একটি যথাযথ সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে বিদ্যমান মোটর সাইকেল চালকদের যথাযথ ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। রাজধানীর বাইরে থেকে দেশের যেসব অঞ্চল থেকে মোটর সাইকেল প্রবেশ করেছে তা নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন করে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। রাইড শেয়ারিংয়ের বাণিজ্যিকিকরণ এবং এর সম্প্রসারণ সীমাবদ্ধ করতে হবে। লাগামহীনভাবে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বন্ধ করতে হবে। যেসব রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা কাদের রাইড শেয়ারিংয়ের অনুমোদন দিচ্ছে এবং চালকের শারিরীক ও মানসিক অবস্থা সুস্থ্য ও স্থিতিশীল কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন