স্টাফ রিপোর্টার : ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার ইফতার মানেই যেন চকবাজারের লোভনীয় খাবারের আয়োজন। কালক্রমে এর কদর যেন বেড়েই চলছে। বাহারি নাম আর লোভনীয় স্বাদে অন্য কারো সঙ্গে তুলনা চলে না এই বাজারের ইফতারীর। তাই রমজানের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত জমজমাট থাকে ইফতারের এই বাজার।
দুপুর থেকেই শুরু হয়ে যায় বেচাকেনা। মূলত চকবাজারের শাহী মসজিদকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে বসে ইফতারের সব দোকান। বাদ যায় না রাস্তাগুলোও। এর মাঝেই সারি সারি দোকান দিয়ে সাজিয়ে বসেন ইফতারের পসরা। এখানে সব মিলে পাঁচ শতাধিকের বেশি ইফতারের দোকান বসে প্রতিদিন। এই বাজারে সবচেয়ে নামকরা ইফতার আইটেমটি হলো ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। তবে এটি বিক্রির কৌশলটি অনেক মজার। তারা যেন সুরে সুরে হাঁকডাক ছাড়ে এটি বিক্রিতে। ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়, ধনী-গরীব সবায় খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’ এই ছড়ার মাধ্যমেই সবাইকে আকর্ষণ করে এই ইফতার কিনতে।
কথিত আছে, প্রায় ১২৭ বছর আগে কালেম মিয়া নামের এক বাবুর্চি এই খাবার তৈরি করেছিলেন। এর পর বংশানুক্রমে তাঁর ছেলে আলম থেকে সালেকিন মিয়ার হাত পেরিয়ে এখন এই খাবার চকবাজার ইফতার মার্কেটে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বিক্রি করে থাকেন। বুট, মুরগি, ডিম, কিমা, গিলা, কলিজা, মগজ, ঘি, চিঁড়াসহ প্রায় ১৭টি আইটেম দিয়ে তৈরি হয় ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ঐতিহ্যবাহী ইফতার।
এখানকার বাহারি ইফতারের মধ্যে রয়েছে শিকের সঙ্গে জড়ানো সুতি কাবাব, জালি কাবাব, শাকপুলি, টিকা কাবাব, আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মসল্লম, বঁটি কাবাব, কোফতা, চিকেন কাঠি, শামি কাবাব, শিকের ভারী কাবাব, ডিম চপ, কাচ্চি, তেহারি, মোরগ পোলাও, কবুতর ও কোয়েলের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, মোল্লার হালিম, নুরানি লাচ্ছি, পনির, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, ছানামাঠা, কিমা পরোটা, ছোলা, মুড়ি, ঘুগনি, বেগুনি, আলুর চপ, পেঁয়াজু, আধা কেজি থেকে পাঁচ কেজি ওজনের জাম্বো সাইজ শাহি জিলাপিসহ নানা ধরনের খাবার।
এ ছাড়া আতা-আনারস-বিলেতি গাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফল, পিঠা-পায়েস, মিষ্টিসহ নানা সামগ্রী সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। তবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের ইফতারির আইটেম হচ্ছে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামের বিশেষ মজাদার খাবারটি। শতাধিক বছরের খ্যাতি ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রতিবছর রমজান মাসজুড়ে আয়োজন করা হয় চকবাজারের ইফতারি। অতিমূল্যের কারণে ঐতিহ্যবাহী এই ইফতারি বাজারের জৌলুস দিন দিন কমতে থাকলেও নামডাকের কারণে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে চকবাজারেই ইফতারি কেনাকাটা করতে আসেন।
চকবাজার শাহী মসজিদ সংলগ্ন ইফতারি দোকানদার থেকে জানা যায়, ৭৮ বছর ধরে বংশানুক্রমেই তারা ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রি করেন। তবে অনেকেই বড় বাপের পোলায় খায় নাম ভাঙিয়ে নকল ইফতারি বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি বড় বাপের পোলায় খায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চকবাজারের ইফতারির প্রসিদ্ধ আইটেমের মধ্যে আরেকটি আইটেম হলো শাহী জিলাপি। এটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০০ টাকা করে। মাষকলাই, পোলাওর চাল, ময়দা ও ডালডা দিয়ে তৈরি এ জিলাপি। সুতি কাবাব প্রতি কেজি ৪০০ টাকা। কবুতরের রোস্ট ১৫০ টাকা প্রতি পিস। কোয়েলের রোস্ট ৬০ থেকে ৭০ টাকা প্রতি পিস। আস্ত মুরগির রোস্ট ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পিস ও খাসির রানের রোস্ট ৬০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। আরো অন্যান্য আইটেমের মধ্যে মুঠি কাবাব পিস ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ডিম চপ ১৫ থেকে ২০ টাকা, সমুচা পাঁচ থেকে আট টাকা, আলুর চপ পাঁচ থেকে আট টাকা, সাসলিক পিস ৩০ থেকে হয়েছে ৫০ টাকা, গরুর সুতি কাবাব ৬০০ টাকা, বটি কাবাব ফুল ১৪০ টাকা, রেশমি জিলাপি ৩০০ টাকা, শাহী জিলাপি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, শাহী হালিম বড় হাঁড়ি ৩৫০ টাকা, ছোট হাঁড়ি ১৫০ টাকা। দইবড়া কেজি ১৬০ টাকা, কাশ্মীরী শরবত ২০০ টাকা, দুধের শরবত লিটার ২৪০ টাকা, বোরহানি লিটার ১২০ টাকা, চিকেন স্টিক পিস ৭০ টাকা, চিকেন নাগেট ৫০ টাকা, কিমা পরোটা ৩০ টাকা, টানা পরোটা ২০ টাকা।
ধানমন্ডি থেকে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঐতিহ্যের ইফতারি কিনতে এসেছেন ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিবছরই এখানে ইফতারি কিনতে আসি। নানা ধরনের ইফতারি সামগ্রী এখানে পাওয়া যায় বলে ভোজন বিলাসীরা এখানে ভিড় জমান। এবার প্রথম দিনেই চলে এসেছি। চকবাজারে ইফতারি কিনতে আসা পুরান ঢাকার অধিবাসী আমিন মিয়া বলেন, পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ভোজন বিলাসী ইফতারিতে নানা আইটেম ছাড়া তাদের ইফতারি হয় না। তাই বংশগতভাবে আমরা এখানে ইফতারি কিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন