শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভিআইপি সংস্কৃতি এবং জনভোগান্তি

জাকারিয়া জাহাঙ্গীর | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

২০১০ সালের ১৬ জুলাই জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। তাঁর নিরাপত্তা ও প্রটোকলে সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটি সারাদিনের জন্য বরাদ্দ করেছিলো স্থানীয় স্বাস্থ্য দপ্তর। দৈনিক প্রথম আলোর সরিষাবাড়ী উপজেলা প্রতিনিধি শফিকুল ইসলামের স্ত্রীকে সেদিন প্রসবজনিত ব্যথায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক গর্ভের বাচ্চা ও মায়ের জীবন শঙ্কায় তাঁকে উচ্চতর হাসপাতালে স্থানান্তর করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য উপদেষ্টার প্রটোকল রক্ষায় অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যস্ত থাকায় মিলেনি সরকারি এই অ্যাম্বুলেন্স। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে আনা ভাড়ায়চালিত বাহনের মাধ্যমে উচ্চতর হাসপাতালে নিতে হয়। সম্প্রতি এমনই এক ‘ভিআইপি সুবিধা’র অপব্যবহারে জীবন দিতে হয়েছে তিতাস ঘোষ (১২) নামে নড়াইলের এক স্কুলছাত্রকে।
নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ও বড়কালিয়া গ্রামের মৃত তাপস ঘোষের ছেলে তিতাসকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য উন্নত চিকিৎসা নিতে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১নং ফেরিঘাট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় আনা হচ্ছিল। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুস সবুর মন্ডল ফেরিতে করে ঢাকায় ফিরবেন, আর তাঁর গাড়ি আসতে দেরি করায় ফেরি ছাড়তে তিন ঘণ্টা বিলম্ব হয়। রাত ৮টার দিকে ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্সটি পৌঁছলেও ‘ভিআইপি’ মর্যাদা রক্ষায় তা ছাড়া হয় রাত ১১টায়। এ অবস্থায় ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু হয় স্কুলছাত্র তিতাসের। ঘটনার সময় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেও প্রতিকার পায়নি তিতাসের পরিবার। আমাদের ভাবতে অবাক লাগে, কতটা নিরুপায় হলে এই ‘ভিআইপি’দের কাছে সাধারণ মানুষকে জিম্মি হতে হয়। জনভোগান্তির নামে এসব ‘ভিআইপি সুবিধা’র অপব্যবহার থেকে জাতিকে মুক্তি না দিলে দিনেদিনে রুদ্ধ হয়ে যাবে উন্নত রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন।
তিতাসের বড় বোন কেয়া ঘোষ’র আবেগঘন ফেসবুক স্ট্যাটাস সচেতন মানুষকে আপ্লুত করেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ বলে কি, আমাদের জীবনের কোন মূল্য নেই? সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে একজন ভিআইপির আত্মীয়ের ভ্রমণের জন্য তিন থেকে চার ঘন্টা ফেরি আটকে রাখা কি বেশি গুরুত্বপ‚র্ণ। একটা ফুলের মত জীবন ঝরে গেল শুধুমাত্র নৌ-মন্ত্রনালয়ের ভিআইপির আত্বীয়ের খামখেয়ালি কারণে। এভাবে আমাদের দেশে বহু জীবন যায় তাদের খামখেয়ালির কারণে। এভাবেই কি চলবে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ’। রাষ্ট্র কাউকে অপরাধ করতে শেখায় না; তবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক বা উচ্চপদস্থগণের ব্যক্তিগত মানসিকতার জন্য জনগণ ভোগান্তির শিকার হলে, তার দায়ভারও রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থদের সিন্ডিকেট ও অসাধু কর্মতৎপরতা শক্তপোক্ত আসন গড়ে উঠেছে। মাত্রাতিরিক্ত ‘আমলানির্ভরতা’ দিনেদিনে সরকারকে আরো বেশি অসহায় করে তুলেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রশাসন চালাবার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষ রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও আমলাদের হাতে চলে যাবার কারণে অসাধু কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিতাসের বড় বোনের স্ট্যাটাস আরেকটু পড়লে প্রশাসনের অবহেলার প্রমাণ মেলে, ‘আমার ভাইয়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায়, কোন উপায় না দেখে স্থানীয় পুলিশ, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা এমনকি ৯৯৯ হেল্পলাইনে ফোন করি। কিন্তু কারো কাছ থেকে কোন সাড়া পাইনি, এমনকি ফেরি কর্তৃপক্ষের কাছে শত আকুতি জানানোর পরও তারা জবাব দেয়, ভিআইপির অনুমতি ছাড়া ফেরি ছাড়লে নাকি তাদের চাকরি থাকবে না’।
সচিব থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের সর্বনিম্ন কর্মকর্তা সকলেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তথা জনগনের সেবক। জান, মাল, সম্মান রক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের গৃহীত কর্মসূচি ‘জনগণের রক্ষক’ হিসেবে পালন করাই তাঁদের দায়িত্ব। এদের অধিকাংশই ‘রক্ষক হয়ে ভক্ষক’-এর ভ‚মিকা পালন করতে যেন সচেষ্ট। তাঁদের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেগুলো নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। অথচ ওইদিন ওয়াহিদুল ইসলাম ‘ভিআইপি যাবে’ বলে ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপককে বার্তা পাঠান, যা গণমাধ্যমে এসেছে। ম‚লত তাঁর কথামতোই দেরিতে ফেরি ছাড়া হয় এবং মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় তিতাস। শুরুতেই তদন্ত কমিটি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হলে তদন্ত কী হবে তা বুঝতেবাকি থাকে না।
কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে যান দুইজন প্রতিমন্ত্রী। তাঁদের সংবর্ধনা দিতে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টানা দুই ঘণ্টা প্রচন্ড রোদে দু’টি বিদ্যালয়ের সাত শতাধিক শিক্ষার্থীকে ব্যানার-ফেস্টুনসহ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও দায়ী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায়নি। শিক্ষার্থীদের রোদে বা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কোনো অতিথিকে সংবর্ধনা প্রদান না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র ও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। জনপ্রতিনিধি বা ভিআইপি অতিথিদের ‘মনোতুষ্টি’ করতে কোনো কোনো অতিউৎসাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের দিয়ে সারিবদ্ধ লাইন, মানবপ্রাচীর, মানবসেতু তৈরি করে সংবর্ধনা জানায়, যা শিক্ষার্থীদের কোমল মনে অপমানজনক ও রীতিমতো কষ্টকর। এ সবের বিরুদ্ধে সরকারকে সহসাই স্থায়ী উদ্যোগ নিতে হবে।
পাশাপাশি ভিআইপি সুবিধার নামে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে রোগীদের দুর্ভোগসহ জননিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে জাতিকে রক্ষা করা জরুরি। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে কিছু প্রস্তাবনা উল্লেখ করা যেতে পারে- (১) ভিভিআইপি বা ভিআইপিদের চলাচলস্থল, কর্মস‚চির স্থান বা অবস্থাকালীন সময়ের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় প‚র্বে থেকেই তা ঘোষণা করা। (২) জনসাধারণের চলাচল বা কর্মকান্ড বন্ধ করে ভিআইপি সুবিধা না দেয়া। প্রয়োজনে জনসাধারণের জন্য ব্যবহারের বিকল্প স্থান দেখিয়ে দেয়া। (৩) ভিআইপি সুবিধার জন্য জনসাধারণের বরাদ্দকৃত সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রদান না করা। প্রয়োজনে ভিআইপি সুবিধার জন্য এসবের পৃথক ব্যবস্থা করা। ভিআইপিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর লোকদের জনসাধারণের সাথে দ‚র্ব্যবহার না করা। (৪) সংশ্লিষ্ট কারণ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও হাসপাতাল এলাকায় ভিআইপিদের কোনো কর্মস‚চির স্থান নির্ধারণ না করা। (৫) ভিআইপি সুবিধার অপব্যবহারের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণকে অবিলম্বে ন্যায্য ক্ষতিপ‚রণ প্রদান ও দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
ভিআইপি’র ক্ষমতার অপব্যবহারে যেভাবে একটি শিশুর মৃত্যু হলো তা কারো কাম্য নয়। আমরা মনে করি, শিশুটির পরিবারকে অবিলম্বে উপযুক্ত ক্ষতিপ‚রণ দেয়া উচিত। পাশাপাশি তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতির অপব্যবহার রোধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে জনভোগান্তি বন্ধ করা হোক। ভিআইপিদের যে মহান ব্রত- জনগনের সেবা; তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক।
ইমেইল: mzjahangir@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন