একটি আধুনিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন কেমন তা বুঝার জন্য আইনের বড় বড় বই পড়তে হয় না। দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামোর চরিত্রই বলে দেয় আইনের শাসনের নমুনা কেমন। তবে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ একসাথে চলতে পারে না। কারণ এদের অবস্থান দুই মেরুতে বিরাজমান। গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন। আর কর্তৃত্ববাদী শাসন হলো কোনো ব্যক্তির ইচ্ছামাফিক শাসন। গণতন্ত্রের ক্রটি-বিচ্যুতি থাকলেও গণতন্ত্রকে উদার শাসন নীতি বলা হয়। যে সকল দেশে গণতন্ত্রের গ-ও নেই সেসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বৈশিষ্ট্যও অনেক দেশে দেখা যায়। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা উন্নয়নের আফিমে জাতিকে বুঁদ রেখে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে দুর্বল করে দেয়। বিরোধী মতালম্বীদের ওপর দমনপীড়নের স্টিম রোলার প্রয়োগ করতে কুন্ঠাবোধ করে না। এমনকি সাধারণ নাগরিকরাও দমন পীড়নের নির্মমতা থেকে মুক্তি পায় না। সুশাসনের অভাবে তাদের মনের মধ্যে অবদমিত ক্ষোভ জেগে উঠে। অৎান্তেই বলে ওঠে, আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার,বুকের ব্যাথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার।
গত ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়াল্ড জাস্টিস প্রজেক্টসের (ডব্লিউজেপি) এর জরিপে দেখা গেছে বৈশি^ক আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের তালিকার নিচের দিকে অর্থাৎ অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে এ সত্যটি ক্ষমতাসীন দল স্বীকার করতে নারাজ। ডব্লিউজেপির অনুসন্ধানে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২ তম। সংস্থাটির জরিপে চলতি বছরে নতুন আরও ১৩টি দেশ যুক্ত হয়ে মোট ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২ তম স্থানে এসেছে। সূচকের শীর্ষে ডেনমার্ক,নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। সূচকের নিচে আফগানিস্তান,কম্বোডিয়াও ভেনেজুয়েলা। ডব্লিউজেপি সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে সূচক তৈরি করেছে। কিন্তু এই অপরিহার্য উপাদানগুলোর প্রতি কোন সরকারই মনোযোগ দেননি। মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। অথচ সরকারের আইনমন্ত্রী ডব্লিউজেপির জরিপকে পক্ষপাতমূলক হিসেবে অভিহিত করেছেন। যে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই, সে দেশে জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাধ্য কার? ক্ষমতার সিংহাসনে বসে দূর আকাশের নীলিমালাও কাছে মনে হয়। যারাই ক্ষমতায় থাকে তারা দেশি বা বিদেশি কোনো সংস্থার সূচকে ইতিবাচক থাকলে লুফে নেয়। এমনকি ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে। কিন্তু সূচকে নেতিবাচক থাকলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। সত্যকে গ্রহণ করতে যেমন হৃদয় কাঁপে তেমনি মিথ্যার আশ্রয় নিতেও কুন্ঠাবোধ করে না।
মামলার জট কিংবা নিষ্পত্তিহীন মামলার সংখ্যাটা বড় ব্যাপার নয়। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হচ্ছে,মামলার দীর্ঘসূত্রীতা বাদী ও বিবাদী উভয়ের জীবনকেই বিষিয়ে তোলে। সামান্য বিবাদ ও বিরোধের আপোষ চাইতে গিয়ে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আর্থিক মানদন্ডে এসব পরিবারের দায় কী শোধ করা সম্ভব? মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে বছরের পর বছর একজন নির্দোষ মানুষকেও জেলখানার বন্দিজীবন কাটাতে হয়। যে কেউ অপরাধী হলে চূড়ান্ত বিচারে তার শাস্তি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চূড়ান্ত বিচার হওয়ার আগেই কাউকে আটকে রাখা কী জুলুম নয়? যাঁরা জেলখানার কয়েদি তারা জানেন, চার দেয়ালের ভেতরের অক্সিজেন আর মুক্ত বাতাসের অক্সিজেন এক জিনিস নয়। মামলার কারণে মানুষের জীবন থেকে মূল্যবান সময় হারিয়ে যাচ্ছে তা পৃথিবীর কোন ব্যাংক নোট দিয়ে কী শোধ করা সম্ভব? মানুষের অধিকার যখন ভুলন্ঠিত হয় তখন মানুষ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আদালতের শরনাপন্ন হয়। কিন্তু আদালতের নিকট থেকে কাক্সিক্ষতমানের সেবা মানুষ কতটুকু পাচ্ছে তা-ই দেখার বিষয়। একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে,মাত্র এক বছরে দুই লাখ ১৫ হাজারের বেশি নতুন মামলা অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা এখন প্রায় ৩৬ লাখ।
দেশে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ও মামলার জট কেন বাড়ছে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি মামলার জট বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বিশেষ কতগুলো কারণ নিহীত রয়েছে। যেমন: মামলার তদন্ত রির্পোট প্রদানে দেরি হওয়া, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, সাক্ষী গ্রহণে বিলম্ব,দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনানী মুলতবি ও উচ্চ আদালতে মামলার অনুপাতে বিচারক ও বেঞ্চ সংকট, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর জুলুম নির্যাতনে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। একশ্রেণীর পুলিশের অতি উৎসাহী মনোভাবের কারণে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় বাদী বা বিবাদী সারাজীবন ধরে এমনকি বংশপরস্পরায় মামলা চালিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। তবে ফৌজদারি মামলা বেড়ে যাওয়া পেছনে যতগুলো কারণ নিহীত রয়েছে তার মধ্যে প্রধানতম হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা সব সরকারেরই আমলে কম-বেশি আজ্ঞাবহ হাতিয়ারের গন্ডির বাহিরে যেতে পারেনি। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে আসার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও মামলাগুলো নিস্পত্তি হয় না বিচারক সংকটের কারণে।বাংলাদেশে মামলার তুলনায় বিচারকের অনুপাত খুবই কম। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য বিচারক মাত্র একজন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোকের বিপরীতে যেখানে বিচারক ১০ জন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন,ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন এবং ভারতে ১৮ জন। এসব কারণে বিচারপ্রার্থী মানুষ যথাসময়ে বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত ২৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে সুপ্রিমকোর্ট থেকে গায়েব হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নথি। ভাবতেই গা শিউরে উঠে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে যদি নথি গায়েব হয়ে যায় তাহলে তো মামলার জট বাড়বেই। পত্রিকাটি রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে প্রায় গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি উধাও এবং ইচ্ছে করে নথি লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। টাকা দিলে তা বের করে দেয়ার অভিযোগও আছে। তবে এর সঙ্গে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। মামলার নথি এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। মামলার ফাইল গায়েব হলে বিচারপ্রার্থী যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হবে তেমনি ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হবে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত নি¤œ আদালত থেকে যত ফাইল ঊর্ধ্বতন আদালতে যাবে তা স্ক্যান করে মামলার তারিখ বাদী বিবাদীর নামে ইমেল ইস্যু করে ঊর্ধ্বতন আদালতে পাঠানো। যাতে করে হার্ডকপি হারিয়ে গেলেও ডাটা বাহির করা সম্ভব হয়।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সুপ্রিম কোর্টও মামলাজট নিরসনে দেশের সব নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে ৫ বছরের অধিক পুরনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে। ওই সময় সুপ্রিম কোর্টের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বর্তমানে ২৮ লাখের ও বেশি মামলা বিচারাধীন এবং ক্রমেই এই মামলার জট বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচারধীন মামলার মধ্যে ৫ বছরের অধিক পুরনো মামলার সংখ্যাও কম নয়। দেশের সব নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে ৫ বছরের অধিক পুরনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশ দেয়া হলো এবং প্রতিটি আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পুরনো মামলা নিষ্পত্তির তালিকা সুপ্রিম কোর্টে পাঠাইতে হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অধঃস্তন আদালতগুলো পালন করলে মামলার জট অনেকাংশে কমে যেত। গত ২১ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে মুদ্রিত হয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫,০৭,৮৯৮টি। এর মধ্যে ঐ বছরের জনু থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রুজু করা মামলার সংখ্যা ৫৪,৫৪৫টি। এর মধ্যে দেওয়ানী মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৩,৯৭,৩৫৪টি, ফৌজদারী মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৯,৬৭,১৬৫টি এবং অন্যান্য মামলার সংখ্যা হচ্ছে ৮৮,৮৩৪টি। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে দেশের নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৬১৮টি। তবে ২ লাখ ২৯ হাজার ৭৭৪টি মামলা বিগত ৫ বছরর বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৬ হাজার ৯৩৩টি,মোমেনশাহীতে ৯ হাজার ৫৭০টি,খুলনায় ২৩ হাজার ২২১টি,সিলেটে ১৪ হাজার ৪০৯টি,রংপুরে ২৫ হজার ৬৪৫টি,রাজশাহীতে ২৬ হাজার ৪১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৭ হাজার ৮৩৩টি ও ঢাকা বিভাগে ৭৫ হাজার ৭৪৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে। তবে নিষ্পত্তির অপেক্ষার মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। মামলা নিষ্পত্তি করার সময়মীমা দেয়া থাকলেও বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফৌজদারি মামলা যে বাড়ছে সেটা বুঝার জন্য উকিল হওয়ার প্রয়োজন নেই,হাইকোর্টের বারিন্দায় এক চক্কর দিলেই দেখা মিলবে অজস্র তারা মিয়ার মলিন মুখ। হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য গাঁও গেরাম থেকে আসা হাজারো মানুষের করুণ ছবি পত্রিকা খুললেই দেখা যায়। মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিশ্চয় সুলক্ষণ নয়। আইনের শাসনের ব্যতয় ঘটলেই মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। রাষ্ট্র যদি বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্য বিচার যথাসময়ে নিষ্পত্তি করতে না পারে তাহলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে,যা দেশকে সংকটের দিকে ঠেলে দিবে। সবাই যদি আন্তরিকভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দুর্নীতিকে না বলতে পারে তাহলে মামলার জট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টমহল উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন