এক
স্থাপত্য শিল্প মানব জীবনে অতি প্রয়োজনীয় একটি শিল্প। কোন মানুষই একটি বাড়ি ছাড়া স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন ও বসবাস করতে পারে না। বর্তমানে সারা বিশ্বে স্থাপত্য শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গড়ে উঠছে পর্বত সমান নানান অট্টালিকা ও সুউচ্চ স্থাপনা। এমতাবস্থায় ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের জীবন দর্শনের সাথে বিরাট অট্টালিকা ও প্রাসাদ নির্মাণ কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ এবং এ বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য কী? তা জানা আবশ্যক। কুরআনম, হাদীস ও ইমামগণের মতামত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে প্রচুর মতামত রয়েছে। স্থাপত্য শিল্পের সংজ্ঞা নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর বৈশিষ্ট্য, কাঠামো, অবস্থান, উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইসলামের স্বতন্ত্র বক্তব্য। কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করে আমাদের পূর্বসুরি ইমামগণ স্থাপত্য শিল্প নির্মাণে ইসলামের বক্তব্য স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে স্থাপত্য শিল্পের সংজ্ঞা, ইসলামের জীবন দর্শনের সাথে স্থাপত্য শিল্পের সম্পর্ক, স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, স্থাপত্য শিল্পের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়াবলি দলীলসহ আলোচনা করা হয়েছে।
স্থাপত্য একটি শিল্প, এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক না থাকলেও এর সংজ্ঞা নিয়ে স্থাপত্যবিদগণের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থাপত্য শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানের সমন্বয়। স্থাপত্যকে এ কারণেই সকল শিল্পকর্মের উৎস বা Mother of all arts বলা হয়েছে। ‘‘ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, মসজিদের ইতিহাস, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৩, পৃ. ১৭।’’ স্থাপত্যের সংজ্ঞায় কোন কোন ঐতিহাসিক যে কোন নির্মিত বস্তুকে স্থাপত্য বলে অভিহিত করেছেন। আবার কেউ কেউ সুদৃঢ় ও সুশোভিত প্রাসাদকে স্থাপত্য বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘‘ড. মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও হাফিজ মুজতাবা রিজা আহমাদ, স্থাপত্য শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশে মুসলমানদের অবদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৭ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, জানুয়ারি- মার্চ ২০০৮, পৃ. ১০০।’’ স্থাপত্য শিল্প বুঝাতে ইংরেজিতে Architecture পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়। যার শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ হলো, ‘‘ভবনের নকশা বা নির্মাণ-কৌশল বা নির্মাণ রীতি’’। ‘‘Zillur Rahman Siddiqui edited, Bangla Academy English-Bengali Dictonary, Dhaka: Bangla Academy, 2008, p. 37’’ এ প্রক্ষিতেই ড. এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী বলেছেন, সাধারণত Architecture বলতে আমরা মনুষ্য নির্মিত যে কোন প্রকারের স্বল্প পরিসরের কুঁড়েঘর বা প্রশস্ত অট্টালিকা বুঝি। ‘‘এ. কে. এম. ইয়াকুব আলী, মুসলিম স্থাপত্য, রাজশাহী : ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮১, পৃ. ২।’’
প্রফেসর ডবিøউ. আর লেথাবি (W. R. Lethaby) স্থাপত্যের সংজ্ঞায় লিখেছেন, Architecture is the practical art of building touched with emotion, not only past, but now and in the future. ÔÔ W. R. Lethaby, Architecture, London : Macmillan and co., 1892, p. 8; উদ্ধৃত, ড. মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও হাফিজ মুজতাবা রিজা আহমাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০।’’
যদিও স্থাপত্য বলতে কেবল ইমারতেকই বোঝায় না, কারণ ভূমি পরিকল্পনা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া ছাড়াও অসাধারণ ভাস্কর্য চিত্রকলা এবং বিভিন্ন ধরনের নকশা বুঝায়। ‘‘ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭।’’ কিন্তু বর্তমানে প্রবন্ধে স্থাপত্য শিল্প বলতে সাধারণভাবে বাড়ি-ঘর, অট্টালিকা-প্রাসাদ, সুউচ্চ ও মনোরম স্থাপনাকে বুঝানো হচ্ছে। ভূমি পরিকল্পনা ভাস্কর্য, চিত্রকলা, নকশাসহ স্থাপত্য শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলিকে বুঝানো হচ্ছে না।
ইসলামের জীবন দর্শন ও স্থাপত্য শিল্প ঃ মানুষ যুুগে যুগে যেসব শিল্পের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো স্থাপত্য শিল্প। কারণ মানুষের এ পৃথিবীতে আগমনের পর হতেই শীতকালে ঠান্ডা হতে, গ্রীষ্মকালে গরম হতে, বর্ষাকালে বৃষ্টি হতে এবং রাতের অন্ধকারে পশু-প্রাণীর আক্রমণ হতে নিজেদেরকে বাঁচাবার জন্য এ শিল্পের প্রয়োজন হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন উপাসনা, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বা অন্য কোন প্রয়োজনে এক স্থানে একত্রিত হবার জন্যও তাদের এই স্থাপত্য শিল্পের প্রয়োজন হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, মিসরী, ব্যাবিলিয়ন, গ্রিক, রোমান ও সাসানী ইত্যাদি জাতি এ শিল্পের প্রতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছিল। গ্রিক জাতি শিল্প- সংস্কৃতিতে অতি উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। তারা স্থাপত্য শিল্পেও বেশ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিল। তারা এ শিল্পের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও শৈল্পিক দিকটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিল। এ শিল্পে নির্মাণের কৌশলও তারা আবিষ্কার করেছিল। অত:পর প্রত্যেক জাতি ও গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে স্থাপত্য শিল্প নির্মাণ করতে থাকে। ফলে প্রত্যেক জাতির নিজস্ব স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়েছে এবং তাতে তাদের ধর্মীয় দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে সুস্পষ্টভাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইসলাম ধর্ম বৈরাগ্যবাদ সমর্থন করে না। কারণ নবী স. বলেছেন, আমাকে বৈরাগ্যবাদ অবলম্বনের আদেশ দেয়া হয়নি। ‘‘ইমাম আদ-দারিমী, আস-সুনান, তাহকীক : ফাওয়ায আহমাদ যামরালী ও খালিদ আস-সাব’ আল-‘ইলমী, অধ্যায় : আন-নিকাহ, পরিচ্ছেদ : আন-নাহী ‘আনিত তাবাত্তুল, বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ১৪০৭ হি., হাদীস নং- ২১৬৯; হাদীসটির সনদ সহীহ। মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিস সহীহাহ, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তা.বি., হাদীস নং- ৩৯৪।’’
ইসলাম মুসলিমদেরকে শিখিয়েছে যে, মানুষ চাইলে তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তার প্রতিপালকের নিকটবর্তী হতে পারে, তার সন্তুষ্টি পেতে পারে, যদি তা দীনের শিক্ষা ও বিধান অনুযায়ী আদায় করা হয়। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এবং তার সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য বৈরাগ্য সাধনের প্রয়োজন নেই। দুনিয়াদারী ছেড়ে দিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ার এবং দেহকে নানাভাবে কষ্ট দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আল্লাহ কর্তৃক মানুষের জন্য প্রদত্ত কোন নিয়ামতকেও হারাম করার কোন প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় দর্শনে দেখতে পাই যে, স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভ করতে হলে বৈরাগ্য সাধনা করতে হবে। দুনিয়ার ভোগ বিলাস ত্যাগ করে পাহাড় পর্বতে চলে যেতে হবে। সেখানে রাত দিন স্রষ্টার উপাসনায় ব্যস্ত থাকতে হবে। দুনিয়ার সমস্ত ভোগ বিলাস ছেড়ে দিয়ে; মানবদেহকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে স্রষ্টার ধ্যান উপাসনায় মগ্ন থাকলেই তবে পাওয়া যাবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি। তাই এসব ধর্মে অনুসারীদেরকে দুনিয়ার সমস্ত ভোগ বিলাস ত্যাগ করে মানবদেহকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে পাহাড়ে-পর্বতে উপাসনায় ব্যস্ত হতে দেখা যায়।
উপর্যুক্ত এই দর্শনের প্রভাব আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর স্থাপত্য শিল্পেও। বিশেষত তাদের ইবাদত বন্দেগী ও পূজার জন্য নির্মিত বাড়ি-ঘরে। তাই আমরা মুসলিমদের মসজিদগুলো দেখতে পাই যে, তা নির্মিত হয় ভিতর-বাইরে অতি সহজভাবে এবং সাদাসিধে করে, তাদের ধর্মের শিক্ষা ও ধর্মীয় দর্শনের আলোকে। তার অভ্যন্তর ভাগে থাকে না তেমন কোন কারুকার্য, যাতে ভিতরে সালাতরত মুসলিমদের মন সে দিকে মগ্ন হয়ে না পড়ে। আর তার বাহির ভাগ নির্মিত হয় ইসলামী দর্শনের আলোকে প্রায় মিনারা বা আযানখানা সহকারে। আর তাও নির্মিত হয় জনগণের সমাবেশ স্থলে, সড়কের পাশে, বাজারে, চৌরাস্তার মোড়ে এবং এমন সব স্থানে যেখানে সহজেই পৌঁছা যায়। আর তাতে রাখা হয় সামনের বা কিবলার দিক ছাড়া বাকি তিন দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণের জানালা ও দরজা। যাতে তাতে প্রচুর পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। অতএব, মুসলিমরা তাদের দুনিয়াবী কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় এবং দুনিয়াবী কর্মকাণ্ড একই সাথে তাদের প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ মতে আদায় করে তার নৈকট্য লাভ করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, অত:পর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার। ‘‘আল-কুরআন, ৬২ : ১০।’’
অন্য দিকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা মন্দির, মঠ ও গির্জাগুলো নির্মাণ করে পাহাড়ের চূড়ায়, জঙ্গলে এবং লোকালয় থেকে বহু দূরে। আর যদি লোকালয়ের মধ্যে নির্মাণ করা হয়; তবে তার স্থাপত্য রীতিটি করা হয় প্রায় অন্ধকার করে, যাতে মানব সমাজ থেকে অন্তত রূপকভাবে হলেও দূরে অবস্থান করে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে দূরে থেকে তাতে একান্ত মনে উপাসনায় নিয়োজিত হওয়া যায়। এভাবেই হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা যেমন তাদের স্থাপত্য শিল্পগুলো তাদের ধর্মীয় দর্শনের আলোকে তৈরি করেছে, তেমনিভাবে মুসলিমরাও তাদের ধর্মীয় দর্শন অনুযায়ী তাদের ধর্মীয় ইবাদতের স্থান মসজিদগুলোর স্থাপত্য রীতি আলাদা করে নিয়েছে। ফলে তাদের নিজস্ব স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়েছে। ‘‘সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পবোধ, ঢাকা: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৮৩ খ্রি., পৃ. ১৩৯।’’
আমরা যদি প্রাচীন মিসরীয় স্থাপত্য শিল্পগুলো দেখি তার সাথে গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের তুলনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, এতদুভয়ের নির্মাণ কৌশলে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। প্রথমোক্তদের স্থাপত্য শিল্পগুলো যেমন আকারে বড়, তেমনি শক্ত মজবুতও বটে। তা থেকেই বুঝা যায় যে, তারা একটি ধর্মে দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাসী ছিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন