জাহেলী যুগে মক্কার কোরেশদের মধ্যে যে ক’জন গুণী বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি ছিলেন, জাইদ ইবনে আমর ইবনে নোফাইল তাদের মধ্যে অন্যতম। একটি বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর মৃত্যু ৬০৬ খৃষ্টাব্দে। এতে বোঝা যায়, রসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত উমর (রা.) এর চাচাতো ভাই। তিনি মূর্তি পূজাকে ঘৃণা করতেন। তিনি ‘কন্যা শিশু হত্যা’ প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ‘লুপ্ত দ্বীনে ইবরাহিমি’ এর মোতালাশী (সন্ধানী) ছিলেন। সে জাহেলী অন্ধকার যুগে যখন আল্লাহর পূজারী বলতে কেউ ছিল না, সর্বত্র মূর্তি প্রতিমার রাজত্ব ছিল, শির্ক, কুসংস্কারের জয়জয়াকার ছিল, সে ঘোর অন্ধকার যুগে তওহীদের আলোতে আলোকিত হৃদয়গুলোর মধ্যে জাইদ ইবনে আমর ছিলেন বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। আরবের এ কোরেশ নেতা লুপ্ত দ্বীনে ইবরাহিমি এর অনুসারী হলেও এ ধর্মের সব কিছু জানা ছিল না তার। বিশেষত আল্লাহর এবাদত বন্দেগী কীভাবে করতে হয়, তার কাছে কীভাবে চাইতে হয় এসব কিছুই তাঁর জানা ছিল না, বরং তিনি এটাও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, আরবে যেসব কুসংস্কার, পাপাচার, অনাচার প্রচলিত, দ্বীনে ইবরাহিমি এর সাথে ঐগুলোর কোন সম্পর্ক নেই।
সত্যের সাধক জাইদ সারা জীবন সত্যের সাধনা করেছেন, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন নির্ভীক, সোচ্চার কণ্ঠ, নিন্দুকের নিন্দাকে তিনি পরোয়া করতেন না। তার কওমের মধ্যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাব প্রতিপত্তিশালী। অন্যায় অসত্যকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দিতেন না। তার নীতি ছিল; ‘সত্যের আবেদন হচ্ছে বলে দেওয়া, তা ঘোষণা করা এবং তার সমর্থনে লড়াই করা।’
জাইদ ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র-শরীফ। তিনি ছিলেন নির্ভীক, সাহসী, সত্যবাদী। যে কথা গলদ ও অনুচিত মনে করতেন, তার প্রতিবাদ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। তার জবান ছিল সত্যের উলঙ্গ তরবারির ন্যায়। যত প্রভাবশালী শক্তিধর ব্যক্তিই হোক না কেন, মিথ্যাবাদীর প্রতি তার কোন অনুকম্পা ছিল না। তাঁর কৃতিত্ব ও নেতৃত্বের প্রতি সকলেরই আস্থা ছিল। কিন্তু পরিণত বয়সে তা আর অক্ষুণ্ন থাকেনি। তার খান্দানে নুফাইল ইবনে খাত্তাব এ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী হন, কিন্তু অহংকারী হওয়ায় তার গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখন মক্কার মোশরেকী শাসন ব্যবস্থার প্রতি যে চার জন নেতা অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাদের মধ্যে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ছিলেন প্রতিভাবান, শিক্ষিত। কিন্তু তিনি একাগ্রতা ও নির্জনতা পছন্দ করতেন বিধায় কর্মক্ষেত্রে তার তেমন ভ‚মিকা ছিল না।
তার বিপরীত জাইদ লেখা পড়ায় তেমন অগ্রসর ছিলেন না। কিন্তু সত্যের প্রতি বিশ্বাস ও কর্ম তৎপরতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সঙ্গী সাথীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ সেরা। জন্মগতভাবেই তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ। তাই এগুলো তার জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছিল। বৃদ্ধ বয়সে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, তার জাতি যে ধর্ম অনুসরণ করে চলেছে তার সাথে ইবরাহিমী ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ইবরাহীম (আ.) না ছিলেন মোশরেক না ছিলেন মূর্তি পূজক, বরং তিনি ছিলেন একমাত্র আল্লাহর উপসনাকারী। আল্লাহ একমাত্র খালেক, একমাত্র রাজ্জাক, একমাত্র মালেক। তিনি একক, তার কোন শরীক নেই। এসব অনুভ‚তি তাকে অধীর অস্থির করে তোলে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না কীভাবে আল্লাহর এবাদত করা যাবে, কী বলে তাকে ডাকা হবে। এসব চিন্তা ভাবনা তাকে বিচলিত ও অস্থির থাকেন। এক আল্লাহতে তার অগাধ বিশ^াস, কিন্তু আল্লাহকে স্মরণ করার, তাকে ডাকার কোন উপায়-মাধ্যম তার জানা নেই। সমাজে প্রচলিত সকল অনাচার, অবিচার দেখে তিনি হতাশ, আল্লাহর কাছে কীভাবে ফরিয়াদ করবেন তাও অজানা। এসময় একদিন বললেন, হে আল্লাহ! আমরা জানতাম তুমি বিদ্যমান, তুমি একক, তুমি শ্রবণকারী, তুমি দ্রষ্টা, কিন্তু আমরা জানিনা কীভাবে তোমার পূজা করব, তোমাকে কীভাবে ডাকব, তোমাকে কী বলে ডাকব? তোমার কাছে কীভাবে চাইব, কী করে চাইব, তোমার আনুগত্য করলে কীভাবে কোন রকমে করব, কোন বিষয়গুলো ছেড়ে দেব, কোন বিষয়গুলো অবলম্বন করব।
তার মত অনেকের ছিল এসব ফরিয়াদ, কিন্তু এর জবাব তাদের জানা ছিল না। ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবরানি ভাষা শিখেছিলেন। তিনি ইঞ্জিল (বাইবেল) ও তওরাত পড়েছিলেন এবং তা সৌভাগ্য মনে করে খৃষ্টান হয়ে যান। উসমান ইবনে হোওয়ায়রেস কায়সারের দরবারে পৌঁছেন এবং খৃষ্ট ধর্মের অনুসরণ করে চলতে থাকেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ দোটানা অবস্থায় হাবুডুবু খেতে থাকেন। কিন্তু জাইদ ছিলেন এমন ব্যক্তি যিনি ওয়ারাকা এর নিকট ইঞ্জিলের ব্যাখ্যা শুনে ছিলেন। কিন্তু ত্রিত্ববাদের ঝনঝাট তার মুক্তমনকে গ্রাস করতে ব্যর্থ হয়। তিনি খৃষ্টান হন এবং সত্যের সন্ধানে উদ্বাস্তুর ন্যায় ঘুরতে থাকেন। তওহীদের চাহিদাগুলো কী তার সঠিক ইলম তার ছিল না, তবে তার পূর্ণ বিশ^াস ছিল যে, মূর্তি পূজা ও শিরক সত্য নয় বরং মিথ্যা ও বাতিল এবং তিনি নিজের কর্তব্য মনে করেন যে, তিনি যে কথাকে সত্য মনে করেন, তিনি তা ঘোষণা করবেন এবং যা মিথ্যা মনে করবেন প্রকাশ্যে তা প্রত্যাখ্যান করবেন, তিনি তার সঙ্গীদের ন্যায় চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না।
এটি সে সময়ের কথা, যখন খানা-ই কাবাকে গোসল দেওয়ার অনুষ্ঠান উপলক্ষে সকল গোত্রের প্রতিনিধিবর্গ এবং সর্দারগণ তাদের দেবতাগুলোর পদ ধৌত করছিলেন এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্বের জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন। এই সময় জাইদ সেখানে পৌঁছেন এবং কাবায় প্রবেশ করেন। উপস্থিত মূর্তি পূজারীরা তাদের কল্পিত খোদাগুলো সুগন্ধিময় পানি দিয়ে গোসল দিচ্ছে। জাইদ তাদের প্রতি আক্রোশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বায়তুল্লাহ তোওয়াফ করতে থাকেন। অতঃপর কাবার প্রাচীরে টেক লাগিয়ে বসে যান। এরপর কোরেশদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে কোরেশের লোক সকল!’ এ বাক্য উচ্চারণ করার সাথে সাথে এ বৃদ্ধের আওয়াজ দ্রুত কাবার ভেতরে গুঞ্জণ করে উঠে এবং সকলের কান খাড়া হয়ে যায় এবং সকলে নিজ নিজ কর্ম ছেড়ে বৃদ্ধের দিকে ধাবিত হতে থাকে। জাইদ বসা অবস্থায় যা বললেন, হজরত আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) এর জবানী নিম্নরূপ: “আমি বৃদ্ধ জাইদকে কাবার সাথে টেক লাগিয়ে বসা অবস্থায় দেখি এবং তিনি বলছিলেন, ‘হে কোরেশদের লোকজন! কসম সে সত্তার যার কব্জায় জাইদ ইবনে উমরের প্রাণ। আমি ব্যতীত তোমাদের মধ্যে কেউই দ্বীনে ইবরাহীমের উপর প্রতিষ্ঠিত নেই।’
লোকেরা জানত যে, মূর্তি পূজা এবং শিরক তাদের পূর্ব পুরুষ ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) এর ধর্মে ছিল না, তারা এর বিপরীত মোশরেকী কার্যকলাপগুলোর ব্যাখ্যা অবশ্যই প্রদান করে থাকে। কিন্তু কখনও এই কথা বলার সাহস হয়নি যে, ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)ও মোশরেক ছিলেন অথবা মূর্তি পূজা করতেন অথবা তারা মূর্তিগুলোর পূজা এবং আল্লাহর সাথে শরিক করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এজন্যই এসকল মূর্তি পূজারীর কাছে জাইদের অভিযোগের কোন জবাব ছিল না যে, তারা দ্বীনে ইবরাহিমী এর ওপর কায়েম ছিল। এ কারণে তারা উহা খন্ডন করতে পারছিল না। কিন্তু তারা অবশ্যই জানত যে, ইবরাহীম (আ.) এর তরিকা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সে জ্ঞান কারও নেই যে, ইবরাহীম (আ.) কোন কোন বিষয়ের শিক্ষা দিয়েছিলেন আল্লাহর এবাদত বন্দেগীর এবং তার পূজা অর্চনার কোন কোন পদ্ধতি বাতলিয়ে ছিলেন। তাদের অজ্ঞতার, গুমরাহি ও পথভ্রষ্টতার এটাই প্রাথমিক কারণ। জাইদ যখন তাদেরকে এভাবে আহ্বান জানান, তখন তারা এটাকে খন্ডন করতে পারল, না কিন্তু তাদের মাথা নিচু হয়ে গেল, তারা বলল, ‘আচ্ছা বলুন! ইবরাহিমী দ্বীন কী ছিল? আমরাতো নিজেদের মূর্তিগুলোর সামনে মস্তক নিচু করে আল্লাহর এবাদত করি?’ জাইদ বলতে পারতেন মূর্তিগুলোর পূজা করা গলদ, কিন্তু আল্লাহর এবাদত কীরূপে করা হবে, ইবরাহীম কোন পদ্ধতিতে এবাদত করেছেন, তিনি খোদ তা জানতেন না, তিনি কীভাবে তা বলবেন?
বৃদ্ধ জাইদকে লা জবাব দেখে ওরা তার প্রতি বিদ্রুপ ও কটুক্তি করতে থাকে যে, ‘বড় ভক্ত এসেছেন, বেচারা ইবরাহিমের দ্বীনের প্রাচারক হিসেবে আল্লাহর অনুগত উত্তম পূজারী যিনি নিজের খোদার এবাদত করার নিয়ম পর্যন্ত জানেন না।’
জাইদ ওদের ঠাট্টা, বিদ্রুপ ও ‘তানা-তিরস্কারের’ কোন জবাব দিলেন না। তিনি কাবার দেয়ালের সাথে পূর্বের ন্যায় টেক লাগিয়ে অসহায়ের মত আসমানের দিকে বার বার তাকাতে থাকেন যেন নিজের প্রতি নিজের অসহায়ত্ব ও অপরাগতার ফরিয়াদ আসমানের মালিকের কাছে এই মর্মে পেশ করছিলেন যে, ‘হে আমার প্রভু! বলে দাও আমি ওদেরকে কী জবাব দেব।’
এ চরম অস্থির উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে বৃদ্ধ জাইদ আল্লাহকে সম্বোধন করে যা বলেছিলেন, হজরত আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) এর বর্ণনানুযায়ী তা নিম্ন রূপ: ‘হে আমার খোদা! আমি যদি জানতাম যে, তোমার কোন নিয়ম পছন্দ, তা হলে আমি তোমার সেই নিয়মেই এবাদত করতাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমি তা জানি না।’
এ কথা বলে জাইদ জমিনে দুই হাত টেক দেন এবং জমিনে মস্তক রেখে বলতে থাকেন, ‘রাব্বি, রাব্বি, রাব্বি, রাব্বি’ অর্থাৎ- ‘হে আমার প্রভু, হে আমার প্রভু, হে আমার প্রভু, হে আমার প্রভু।’ সত্যের সন্ধানী জাহেলী যুগের এক আরব কোরেশ নেতার এক অপূর্ব কাহিনী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন