শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বল্প পানিতে বোরো ধান উৎপাদনে সাফল্য

প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশের ধান গবেষকরা জাতির সামনে আরেকটি সুসংবাদ নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এবার বোরো ধান চাষে পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি উদ্ভাবন করে একটি নতুন আশার আলো প্রজ্বলিত করেছেন। এতে শুধু পানি কম লাগবে না, সেচের জন্য ডিজেল খরচও অনেক কমে যাবে। এ কথা সবার জানা, নদ-নদীগুলো শুকিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। বহু নদ-নদী বিলীন হয়ে গেছে। বড় বড় সেচ প্রকল্পগুলো পানির অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে। পানির অভাবে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি অনাবাদী থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার কারণে প্রায় সর্বত্রই পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে, দেশের প্রধান ফসল বোরোধান চাষে পানির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনার সাফল্য আমাদের কৃষিব্যবস্থা ও পরিবেশের জন্য অনেক বড় ইতিবাচক সংবাদ। গতকাল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিপদ্ধতি বিভাগের অধ্যাপক, ড. মশিউর রহমান দীর্ঘ ১০ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে এবং মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করে পানি সাশ্রয়ী বোরোধান উৎপাদন কৌশলকে এখন কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিতে যাচ্ছেন। দেশের কৃষিবিদ, কৃষিবিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং গণমাধ্যমের সামনে বিষয়টি তুলে ধরতে গতকাল রাজধানীতে একটি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ আজ ধান-চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত চার দশকে আমাদের কৃষকরা তিনগুণের বেশী খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছে। এর পেছনে একদিকে যেমন রয়েছে আমাদের কৃষিবিদ ও কৃষি গবেষকদের উদ্ভাবনী প্রতিভা ও নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস, অন্যদিকে দেশের লাখ লাখ কৃষকের নিরলস পরিশ্রম ও সর্বাত্মক বিনিয়োগ। তবে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির এই সাফল্য অর্জন করতে গিয়ে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ সেচ নির্ভর ধান উৎপাদনে সারফেস এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভের উপর বড় ধরনের টান পড়েছে। বোরো মৌসুমে প্রতিদিন সেচকাজে প্রায় এককোটি লিটার ডিজেল পোড়ানো ছাড়াও হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করতে হচ্ছে। সেই সাথে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ক্ষতি তো আছেই। এ হিসাবে প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে আমাদেরকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে বীজতলা থেকে খাদ্যোপযোগী প্রতিকেজি চাল উৎপাদনের পেছনে ৩৫০০ লিটার পানি খরচ করতে হয়। দেশে উৎপাদিত সাড়ে ৩ কোটি টন ধানের ৫৫ শতাংশের বেশী বোরো ধান। নতুন উদ্ভাবিত ‘ডিরেক্ট সিডেড বোরো রাইস টেকনোলজি’ পদ্ধতিতে তা অর্ধেকে নেমে আসবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও)-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশের নদ-নদী ও ভূ-গর্ভস্থ পানির ৮৮ শতাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে সেচকাজে এবং সেচের পানির ৭৩ ভাগই খরচ হচ্ছে ধান উৎপাদনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই বিপুল পরিমাণ পানির ৯০ ভাগই যোগান হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে। মূলত ধান উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৬ লাখ সেচপাম্পে উত্তোলিত পানির ঘাটতি পূরণ না হওয়ায় এখন ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে।
বিশ্বের উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলা করে টেকসই তথা পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করা এই মুহূর্তে সারাবিশ্বেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম ভালনারেবল কান্ট্রি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। একদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে উজানে যৌথনদীতে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ ও অপরিণামদর্শী পানি প্রত্যাহারের ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এ সব বিষয় বিবেচনা করে আমাদের কৃষিব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরী। প্রফেসর মশিউর রহমান ও তার সহকর্মীদের উদ্ভাবিত ‘ডাইরেক্ট সিডেড বোরো রাইস টেকনোলজি’ এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে নতুন আশাবাদ দেখাচ্ছে। প্রচুর পানিসেচ ও আবদ্ধ পানিতে বোরোধানে বীজতলা তৈরী এবং চারা রোপণের পর প্রতিদিন পানি দিয়ে ধানক্ষেত তলিয়ে দেয়ার বদলে ভেজা বীজধান সরাসরি জমিতে বুনে দেয়ার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধানচাষে পানির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে উদ্ভাবকরা দাবী করছেন। ভূগর্ভস্থ পানি, ডিজেল এবং বিদ্যুতের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারলে ধানের উৎপাদন খরচ কমে আসার পাশাপাশি অতিরিক্ত সেচ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্ভর কৃষিব্যবস্থার কারণে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। এবারে কম পানি খরচ করে বোরো উৎপাদন কৌশলকে কাজে লাগাতে পারলে তা’ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের মাইলফলক হয়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কৃষিবিজ্ঞানীদের এই সাফল্য সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে বোরোচাষীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন