গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে ২ লাখ বিদেশী বছরে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৪০ হাজার কোটি টাকা তাদের স্বদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয় বলে ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে। এই ২ লাখ বিদেশী, মার্কেটিং এবং মেনুফ্যাকচারিং সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছে। প্রস্তাবিত বাজেট ডকুমেন্টে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছেন যে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে বিপুল পরিমাণে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। ইংরেজি দৈনিকটির ওই রিপোর্টে জব মার্কেট বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধার মারাত্মক অভাব রয়েছে। ফলে এ দেশে দক্ষ শ্রমিক গড়ে ওঠে না। এর ফলে দক্ষ শ্রমিকের অভাব মেটানোর জন্য উদ্যোক্তারা বা শিল্পমালিকরা বিদেশী দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করতে বাধ্য হন। একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। জব মার্কেট বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের চাকরির বাজারে প্রতি বছর ২০ লাখ যুবক প্রবেশ করে। এদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ প্রশিক্ষণ লাভ করে, অবশিষ্ট ৯৫ শতাংশ প্রশিক্ষণের অভাবে অদক্ষ হয়। এই ৯৫ শতাংশ’র স্থান পূরণ করছে বিদেশী জনশক্তি, বিশেষ করে ভারতীয় জনশক্তি। ‘দক্ষ জনশক্তি তৈরি’ শীর্ষক একটি ডকুমেন্টের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে ওই রিপোর্টে। বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প, তৈরী পোশাক শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ, রসায়ন এবং হাল্কা প্রকৌশলে দক্ষ জনশক্তির রয়েছে তীব্র অভাব। এই দক্ষ জনশক্তির মধ্যে আবার রয়েছে ব্যবস্থাপনা এবং তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত জনশক্তি।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন যে, বস্ত্রশিল্প এবং তৈরী পোশাক শিল্পে দক্ষ জনশক্তির অভাব শিল্পের এই দু’টি খাতের বিকাশকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন যে, দক্ষ জনশক্তির অভাবে তৈরী পোশাক শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীকে বহুমুখী করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ যে কতদূর পিছিয়ে পড়েছে সেটি একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝা যায়। চলতি সালের দুই মাসে তৈরী পোশাক খাতে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধির হার ২৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৮.৫২ শতাংশ। দক্ষ জনশক্তির বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে মুহিত আরো বলেছেন যে, বাংলাদেশ যদি বিদেশে বেশি করে জনশক্তি প্রেরণ করতে পারত তাহলে আরো বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত। তিনি বলেন, একজন অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে এবং দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করে। এত লম্বা সময় ধরে এত কঠোর পরিশ্রম করে তারা যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে পাঠায় একজন দক্ষ শ্রমিক তার চেয়ে কম সময়ে কম পরিশ্রম করে তার চেয়ে বেশি অর্থ পাঠায়। অর্থমন্ত্রীর প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে বিশ্বের ১২৭টি দেশে বাংলাদেশের ৭০ লাখ জনশক্তি কাজ করছে। তারা বছরে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ১২ লাখ কোটি টাকা স্বদেশে প্রেরণ করেছে। অর্থাৎ তাদের ফরেন রেমিট্যান্স হলো ১২ লাখ কোটি টাকা। বিদেশে যত বাংলাদেশী কর্মী আছেন তাদের ১৪ শতাংশ আধাদক্ষ, ৩১ শতাংশ দক্ষ এবং ৫২ শতাংশ অদক্ষ। বাজেট ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায় যে, প্রবাসী জনশক্তির মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ হলেন ডাক্তার এবং প্রকৌশলী। আমাদের দক্ষ জনশক্তির এত অভাব কেন? অভাব এ জন্য যে, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত নয়। প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা প্রশিক্ষিত নয় কেন? উত্তর হলো, তাদের দক্ষভাবে গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা দরকার সে ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে বিদেশীরা, বিশেষ করে ভারতীয়রা। আমরা উঠতে বসতে স্বাধীনতার কথা বলি। অবশ্যই বলব। উঠতে বসতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর গত হয়ে গেল। অথচ এই ৪৪ বছরেও সরকার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি যোগ্যতার অভাব? বিষয়টিকে ইচ্ছাকৃত বলেই মনে হয়। কারণ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে যোগ্যতার অভাব আছে, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। যদি ইচ্ছাকৃত হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয়দেরকে বাংলাদেশের চাকরির বাজারে ঢোকানোর জন্যই কি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে সুপরিকল্পিত গাফিলতি করা হয়েছে? রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে দুই লাখ বিদেশী বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে কাজ করছে তারা সবাই বৈধভাবে কাজ করছে। কিন্তু সবাই জানেন যে, এই ২ লাখ ছাড়াও আরো বিপুল সংখ্যক বিদেশী অবৈধভাবে এদেশে কাজ করছে। অবৈধ কর্মীদের সংখ্যা নিরূপণ শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও কঠিন। কাজেই বাংলাদেশে অবৈধ কর্মীর সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেছেন, এই সংখ্যা ৪০ লাখ। রাজনৈতিক নেতারা পরিসংখ্যান হাতে নিয়ে কথা বলেন না। তাই আমরা জনাব রবের সংখ্যাটি গ্রহণ না করলেও ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট এখানে উল্লেখ করতে পারি। বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, অন্তত ৫ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করছে। এদের বেশিরভাগই নাকি অবৈধ।
যে দেশে বেকারের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যায়, সে দেশে যদি ৫-৭ লাখ বিদেশী কাজ করে তাহলে তারা বাংলাদেশের মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে এমন কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যে প্রকাশ, এখন প্রতি বছর যে লাখ লাখ মানুষ বেকার হচ্ছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শিক্ষিত। নিশ্চিত বেকারের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এই শিক্ষিত বেকারের মধ্যে অনেকে বিএ, এমএ রয়েছে। অশিক্ষিত বেকারদের চেয়ে শিক্ষিত বেকারদের প্রশিক্ষণ দেয়া তুলনামূলকভাবে কম পরিশ্রম ও কম সময়সাপেক্ষ। এটি আমাদের জাতীয় লজ্জা যে দেশের বিএ, এমএ পাস যুবকদের বেকার রেখে আমরা বিদেশীদের বিশেষ করে ভারতীয়দের আমাদের জব মার্কেটে বিপুলভাবে এন্ট্রি দিচ্ছি। ভারতে বিশেষ করে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসামের নবনিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল প্রতিদিন তারস্বরে চিৎকার করছেন যে, বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ নাকি আসামে প্রবেশ করছে। আসামে প্রবেশ করে তারা অসমীয়াদের ভাত মারছে। অর্থাৎ আসামে তারা চাকরিবাকরি করছে, একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। এসব বাংলাদেশীদের আসামের বিজেপি সরকার মোটেই বরদাস্ত করতে রাজি নয়। নতুন আসাম সরকারের ঘোষণা, যারা অবৈধ তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে। আর নতুন কেউ যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য একদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হবে, অন্যদিকে তাদের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য তাদের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বা বিএসএফকে নির্দেশ দেয়া হবে। আসামে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে যে জিগির তোলা হয়েছিল, কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গেও সেই জিগির তোলা হয়েছিল। তবে ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই জিগির অনেক কমেছে। বাংলাদেশীদের ভূমিকা এ ব্যাপারে পরিষ্কার হওয়া উচিত। আমাদের খাবার উদ্বৃত্ত নয়। এই অপ্রতুল খাবারে অন্য কাউকে আমরা ভাগ বসাতে দেবো না। দক্ষ এবং অদক্ষের প্রশ্ন তোলা হলে অবিলম্বে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হোক। সে জন্য যতগুলো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা দরকার, সেটি কালবিলম্ব না করে করা হোক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন