শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

গুরুতর প্রশ্নের মুখে শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা যে কতটা নাজুক তা আবারও প্রমাণ পাওয়া গেল। গত মঙ্গলবার রানওয়েতে ধাতব টুকরা পড়ে থাকতে দেখে নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানকে ৩৭ মিনিট আকাশে উড়তে হয়। নিরাপত্তা ও নজরদারি কতটা বেহাল হলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তা এ ঘটনা থেকে বুঝতে বাকি থাকে না। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানকে নিরাপদে অবতরণের জন্য শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যদের গিয়ে ধাতব বস্তু সরিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। তারপর বিমান অবতরণ করে। গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, নিয়মিত রুটিন হলেও রানওয়ে পরিদর্শনের জন্য এয়ার ট্রাফিক সিস্টেম (এটিএস) বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিনে কাজ করছে না। বার্ড শুটার দিয়ে রানওয়ে পরিদর্শন কাজ চালানো হয়। ঘটনার দিন এ কাজের জন্য নির্ধারিত একমাত্র গাড়িটি কর্মকর্তাদের ইফতার আনার কাজে ব্যস্ত ছিল। বিকাল ৫টার পর কেউ রানওয়ে দেখতে যায়নি। ফলে ৩ ঘণ্টা ধরে ধাতব বস্তুটি পড়েছিল। এর ফলেই প্রধানমন্ত্রীর বিমানকে ৩৭ মিনিট ধরে আকাশে উড়তে হয়। তার আগে ধাতব বস্তু পড়ে থাকা অবস্থায়ই ৯টি বিমান উঠা-নামা করে। বলা যায়, আল্লাহর রহমতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ ধরনের ঘটনা বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা এবং অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই নয়। বলাবাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর বিমান অবতরণের ক্ষেত্রে যদি এ অবস্থা হয়, তবে সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানের ক্ষেত্রে কী অবহেলা প্রদর্শন করা হয়, তা বোধকরি বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। এতদিন বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে নানা অনিয়ম, যাত্রী হয়রানি, লাগেজ খোয়া যাওয়া, লাগেজ কেটে মালামাল রেখে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও, এখন বিমানের উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রেও চরম অবহেলা ও উদাসীনতা দেখা গেল।
শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মারাত্মক ত্রুটি নিয়ে বহুদিন ধরেই অভিযোগ উঠেছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে তো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কার্গো নিষেধাজ্ঞাই জারি করে। এর কারণ যে বিমান কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ও অদক্ষতা, তাতে সন্দেহ নেই। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা চরমভাবে বিনষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা খেয়েও বিমান কর্তৃপক্ষের যে হুঁশ হয়নি, তা প্রধানমন্ত্রীর বিমান অবতরণের বিলম্ব থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, কথিত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই প্রতিদিন যাত্রীদের নানামুখী হয়রানির শিকার হওয়া ছাড়াও তাদের লাগেজের মালামাল যেমন খোয়া যাচ্ছে, তেমনি লাগেজ কেটে মালামাল চুরিও হচ্ছে। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ লাগেজ খোয়া বা কেটে মালামাল নিয়ে যাচ্ছে লাগেজ কাটা সিন্ডিকেট। যাত্রীদের প্রশ্ন : বিমানবন্দরে আছে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী, আছে সিসি ক্যামেরা, আছে সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, এপিবিএন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, তারপরও কীভাবে লাগেজ পার্টির দৌরাত্ম্য চলছে? জানা যায়, বিমান বন্দরে প্রায় অর্ধশত লাগেজ পার্টি গ্রুপ সক্রিয়। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। যারা দায়িত্বে আছেন, তারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যাত্রী হয়রানির মদদ ও লাগেজ উধাও করে দেয়ার কথিত সিন্ডিকেটকে সহায়তা করছেন। তারা প্রশ্রয় না দিলে যাত্রীদের এভাবে হয়রানি হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বিশ্বের কোনো বিমানবন্দরে যাত্রীদের এভাবে হেনস্থা হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। বিমান বন্দরে যে শুধু সাধারণ যাত্রীদের লাগেজ খোয়া যাচ্ছে তা নয়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রীরও লাগেজ খোয়া গেছে বলে পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের লাগেজ খোয়া যায়। অনেক দিন পর লাগেজ উদ্ধার হলেও তাতে কিছুই ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী থাকাকালীন বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের লাগেজও খোয়া যায়। সে সময় থানায় জিডি পর্যন্ত করা হয়েছিল। সাবেক বিমানমন্ত্রী জিএম কাদেরের লাগেজও লাপাত্তা হয়েছিল। মন্ত্রীদের লাগেজ খোয়া যাওয়ার ঘটনার যখন কোনো সুরাহা হয় না, তখন সাধারণ যাত্রীদের অবস্থা কী তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। যাত্রীরা এখন এ আশঙ্কাও করছেন, লাগেজ কেটে তাদের মূল্যবান মালামাল নেয়ার পর যদি মাদক, বিস্ফোরক বা অন্য কোনো চোরাই মাল ভরে দেয়া হয়, তাহলে তাদের বিপদের শেষ থাকবে না। একদিকে বৈধ মালামাল খোয়া তো গেলই, অন্যদিকে নিষিদ্ধ দ্রব্যবহনের দায়েও ফেঁসে যেতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সিসি ক্যামেরায় লাগেজ চুরির দৃশ্য ধরা পড়লেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, লাগেজ চুরির ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও একই কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিমান বন্দরে লাগেজ চুরির মতো ঘটনা ঘটবে কেন? এখানে কম বা বেশি চুরি হচ্ছে, এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দিতে হবে কেন? এ ধরনের ঘটনা তো ঘটারই কথা নয়। মন্ত্রী বলেছেন, রাতারাতি এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাহলে কবে, কতদিনে সম্ভব, তার তো একটা হিসাব দিতে হবে। কেবল করব, করছি, উদ্যোগ নেয়া হচ্ছেÑ এসব কথা বলে বিমান বন্দরকে যে-সে অবস্থায় রেখে দিলে তো হবে না। যাত্রীরা এসব বাহানার অবসান দেখতে চায়।
বিমান বন্দর যে কোনো দেশের একটি জাতীয় প্রতীকের মতো। এর মাধ্যমে একটি দেশের আচার-আচরণ মানুষের ও সভ্যতার পরিচয় ফুটে ওঠে। যাত্রীরা নেমেই দেশটি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে। আমরা আমাদের আতিথেয়তা নিয়ে অত্যন্ত গর্ববোধ করি। বিদেশীরাও মুগ্ধ হয়। তবে এই মুগ্ধ হওয়ার আগে দেশের প্রধানতম প্রবেশ গেট বিমান বন্দর দিয়ে প্রবেশের সময় অতিথিদের যে তিক্ত ও হয়রানিমূলক অভ্যর্থনা পেতে হয়, তাতে দেশের ভাবমর্যাদা লুটিয়ে পড়ে। তখন তাদের কাছে নিজেদের নিরাপত্তাটিই বড় হয়ে দেখা দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার যে ভয়াবহ রকমের ঘাটতি ও গাফিলতি রয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীর বিমান স্বাভাবিক নিয়মে অবতরণ করতে না পারা থেকেই বোঝা যায়। এ ঘটনাকে হালকাভাবে নিলে হবে না, এর অনুপঙ্খ তদন্ত হতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা মনে করি, বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার, যেখানে পেশাদারিত্ব প্রাধান্য পাবে। এর পুরো খোলনলচে বদলে অত্যাধুনিক করতে হবে। যাত্রী হয়রানি করার ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত সিন্ডিকেট চিরতরে বিলুপ্ত করতে হবে। এর সাথে বিমান বন্দরের যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিমান বন্দরকে নিরাপদ করতে সৎ, দক্ষ এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিকল্প নেই। এ কথা মনে রাখতে হবে, বিমানের যাত্রী একটি দেশের জন্য সম্মানের। ফলে তাদের আগমন-নির্গমন নির্বিঘœ ও স্বচ্ছন্দ করার উপর দেশের মানসম্মান নির্ভর করে। আমরা আশা করব, বিমান বন্দরের নিরাপত্তা নিñিদ্র ও ত্রুটিহীন করার জন্য কালক্ষেপণ না করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন